ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের ছিল আমার ছেলেটা। পড়াশুনার পাশাপাশি মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতো। ন্যায় নীতি, মানুষের অধিকার নিয়েও কথা বলতো। পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ ছিল ভালো। আর মাত্র দুই বছর পরেই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে আসতো। তার আগেই দুনিয়া থেকে নাই হয়ে গেল আমার বাপজান। ছেলেকে নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের বাবা খলিলুর রহমান।
গলা আটকানো কান্না জরিত কন্ঠে প্রশ্ন রেখে শহীদ সজলের মা শাহিনা বেগম বলেন, ওরা আমার বাবাটাকে গুলি করে মেরে ফেলে পুড়িয়ে ফেললো কেন? কি দোষ আমার সজলের। আমার বুকটা খালি করলো কেন ওরা? ছেলেটার পুড়ে যাওয়া দেহটা সারাক্ষণ কাঁদায়।
সজলের বাবা খলিলুর রহমান জানান, ৫ আগস্ট সকালে ছেলেকে ফোন দিলে সে বলেছিলো তোমরা চিন্তা করো না। আমি মিছিলে আছি। বিকেলে বাসায় ফিরবো। এটাই শেষ কথা ওর সাথে। দুপুরের আগে পরে ও রাত পর্যন্ত বারবার ফোন করেও আর পাইনি তাকে। ফোন বন্ধ দেখায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে হতাশ হয়ে পরি। সজলের মায়ের কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে আসতে থাকে।
সজলের বাবা খলিলুর রহমান বলেন, মানুষের মুখে ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে জানতে পারি সাভারে লাশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। হন্যে হয়ে খুঁজতে যাই সজলকে। গিয়ে দেখি কোন লাশ চেনার উপায় নাই। একপর্যায়ে দেখতে পাই আমার ছেলের ন্যায় দেখতে একটি আধা পোড়া লাশ উপুর হয়ে পড়ে আছে। মাথা ও পিঠের বেশির ভাগ পুড়ে গেছে। গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো। কাছে গিয়ে দেখি আমার সজলের লাশ। গলার আইডি কার্ডটিও তার। ছেলের পুড়ে যাওয়া দেহটা দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছিল। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।
উল্লেখ্য, সাভারের বাইপাইলে মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায় সজল। গুলি করার পর গাড়িতে তুলে আগুন দেওয়া হয়। পুরো এক দিন বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজির পর তাকে গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বাইপাইলে রাজপথে খুঁজে পাওয়া যায়।
সজল ঢাকা সিটি ইউনিভার্সিটির বিএসসি-ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো। বাবা-মার আশা ছিল তাকে একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার বানানো। বাবা খলিলুর রহমান একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। মা শাহিনা বেগম গৃহিণী। শখ করেই সাজ্জাদ হোসেন সজলকে পড়াশোনা করা অবস্থায় বিয়ে করায় তার বাবা-মা। শহীদ সজলের একটি কন্যা সন্তান আছে। নাম আদিবা। বয়স এক বছর দুই মাস।
৬ আগস্ট শহীদ সজলের লাশ দাফন করা হয় গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে নিজ বাড়ির উঠানে। মুক্তিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহসান হাবিব জানান, বাবা-মার কতইনা স্বপ্ন ছিল সজলকে নিয়ে। শহীদ সজল এই এলাকার গর্ব। সারা জীবন তাকে মনে করবে এলাকার লোকজন।
সজলের মা এ প্রতিবেদককে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাবে ছেলের শহীদি মর্যদা চাই। পাঠ্যপুস্তকে গণঅভ্যুত্থানের বীরদের স্মৃতি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি। সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসহাক আলী বলেন, শহীদ সজল ছিলো পরিবারের আশা আকাঙ্খার প্রতীক। আমরা তার পরিবারের লোকজনের খোঁজ খবর রাখছি।
আপনার মন্তব্য লিখুন