অগ্নিকান্ড শব্দটি যতোটা ভয়ংকর, তারচেয়ে শতগুণে বৃদ্ধি বিভীষিকার আগুনে পুড়ে স্বপ্ন ছাই হয়ে যাওয়া নির্মম গদ্যের ন্যায়।
আহা জীবন, আহা স্বপ্ন কোনটাই রেহাই পায়নি এই বিভীষিকাময় তাপযুক্ত হালকা লাল, গাঢ় লাল এবং কমলা রঙের নির্মম আগুন থেকে।
আমরা যেন কোন ভাবেই রেহাই পাচ্ছিনা অগ্নিকাণ্ডের কবল থেকে। প্রতিবছর নিয়ম করেই যেন ছোট, মাঝারি এবং বৃহৎ অগ্নিকাণ্ড দেখে দেশবাসী। আমরা আম জনতা শুধু দেখি আর করুন কন্ঠে আকুতি করি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য। এর বেশি আমাদের কিইবা করার! প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে প্রিন্ট মিডিয়া বড়ো করে ছাপে খবরের কাগজ। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তুলে ধরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, আমরা হিসাব কষি কেনইবা অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। তবে আমাদের অংকের হিসেবে মিলে বা নাই মিলে, বছর ঘুরে অগ্নিকাণ্ডের দেখা কিন্তু ঠিকই মিলে।
সতর্কতা এবং সচেতনতা কোনটাই যেন মিলেছেনা সুফল। লালচে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে দেহ, পুড়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। কেউ হারাচ্ছে সারাজীবনের সঞ্চয়, কেউ হারাচ্ছে চাকুরী আবার কেউবা হারাচ্ছে স্বাদের জীবনটাই।
তবকি রাষ্ট্র কিছুই হারাচ্ছেনা? অর্থ হারাচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান, জীবন হারাচ্ছে একজন, পরিবার হারাচ্ছে প্রিয় মানুষকে। তবে সমষ্টিগত যোগফল হারাচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র হারাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান , রাষ্ট্র হারাচ্ছে কর্মক্ষম শত জীবন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৭৫২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎ গোলযোগে আগুন লাগার ঘটনা ৩৭ হাজার ৪০৪ টি। আর ১৯ হাজার ১২৪টি আগুন লাগে বিভিন্নধরণের চুলা থেকে। হিসাব বলছে, এই দুই ধরনের আগুন মোট দুর্ঘটনার ৫৬ শতাংশ।
তবে আগুনে আর্থিক ক্ষতির হিসাবটা আরও ভয়াবহ। পরিসংখ্যান বলছে, গেলো ৫ বছরে আগুনে আর্থিক ক্ষতি ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিদ্যুৎ গোলযোগে ক্ষতি ৮৩৪ কোটি, যা মোট ক্ষতির ৫৭ শতাংশ। আর চুলার আগুনে আর্থিক ক্ষতি ১৬৬ কোটি বা ১১ শতাংশ। বিদ্যুৎ ঘটিত অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশিরভাগই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে আগুন লাগার অন্যতম কারণ। এজন্য আমাদের সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিককালে লক্ষ করলে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই কোন না কোন শিল্প কারখানা বা বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোতে বেশি প্রতিয়মান। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পরিষদ যেমনি হারাচ্ছে তাদের অর্থিক উন্নয়ন, তেমনি রাষ্ট্র হারাচ্ছে উৎপাদনমুখি প্রতিষ্ঠান। একইসাথে ক্ষুদ্রাংশ ভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্হ হচ্ছে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো পরিবার।
রাষ্ট্র হিসেবে আমরা ক্রমবর্ধমান হারে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের দিকে ধাবিত হচ্ছি। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যার বৃহদাংশ অর্থ আসে উৎপাদনমুখি প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে।
বিগত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১২ সালে সাভারের তাজরীন ফ্যাশন্স অগ্নিকাণ্ড প্রবৃদ্ধির পাটাতন কতটা নাজুক এবং শ্রমিকদের বঞ্চনার হার কত মাত্রায় উঁচু তা উপলব্ধি করা যায়। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনায় পোশাক ও বস্ত্র খাতসহ মোট কারখানা আছে প্রায় সাত হাজার ৮২৪টি। তৈরী পোশাকের বাইরে অন্যসব কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
২০০০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার চৌধুরী নিট ওয়্যারে আগুনে নিহত হয় ৪২ জন শ্রমিক, আগস্ট ২০০১ এ মিরপুরে ম্যাক্রো সোয়েটারে আগুনে ২৪ জন, ২০০৫ সালে জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের শান নিটিং অ্যান্ড প্রসেসিং লিমিটেড আগুনে নিহত হয় ২৮ জন ও একই বছরে এপ্রিলে আশুলিয়ায় স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসে নিহত হয় ৬৪ জন শ্রমিক, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম কেটিএস টেক্সটাইল মিলে আগুনে নিহত হয় ৬৫ জন, একই বছরে ওই মাসেই তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স টেক্সটাইলের ভবন ধসে নিহত হয় ২১ জন
২০১০ সালে ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরের গরিব ও গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হয় ২১ জন একই বছর ডিসেম্বরে আশুলিয়া হামীম গ্রুপের ফ্যাটসইট স্পোর্টস ওয়্যারে আগুনে নিহত হয় ২৯ জন এরপর ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১১২ জন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফেয়লস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয় ৩৫ জন শ্রমিক, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস কারখানায় ও বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হয়। (২০২১) জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হয় শিশুসহ ৫২ জন শ্রমিক। এসব কারখানায় যেসব পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছে তাদের কান্না কি থামবে?
সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ঢকার নীলক্ষেতে বইয়ের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণে অর্থ। কেউবা সারাজীবনের সঞ্চয়ী অর্থ দিয়ে গেড়ে তুলেছেন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, নিমেষেই পুড়ে ছাই তাদের উপার্জনের পথ।
আহা কি কান্না, আহা কি আর্তনাদ, দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলাম অসহায় পরিবারের চোখের পানি।
এভাবেই প্রতিবছর লালচে আগুনে পুড়ে যাবে সবুজ স্বপ্ন, নাকি নিস্তার মিলবে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়া অগ্নিকাণ্ড। প্রয়োজন সচেতনতা, প্রয়োজন অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য উৎস সমূহ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
তবেই হয়তো মিলবে গাঢ় লাল আগুনের কালো ধোয়ায় স্বপ্ন পুড়ে ধূসর বর্নের ছাই হওয়া।
আপনার মন্তব্য লিখুন