চলছে কোরবানির মৌসুম। শহর-গঞ্জে বসেছে পশুর হাট। হরদম কেনাবেচায় কোরবানিদাতাদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। আল্লাহর রাহে কোরবানি দেওয়ার সুযোগ এসেছে। নিজের কষ্টার্জিত অর্থের একটি অংশ আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই যে ফিবছর আমরা কোরবানি করি, পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে মহান প্রভুর সন্তুষ্টি কামনা করি এর ইতিহাস খুবই প্রাচীন।
মানুষের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের ভাষ্যমতে, পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ শুরু হওয়ার সময় থেকেই কোরবানির প্রচলন হয়। আল কোরআনেও একই কথা বলা হয়েছে। হজরত আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল আর কাবিল দুজনে প্রথম কোরবানি করেন। ঘটনাটি হলো, আদম (আ.)-এর সময় ভাইবোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল। মা হাওয়া (আ.) একসঙ্গে দুই সন্তান প্রসব করতেন।
একজন ছেলে অন্যজন মেয়ে। নিয়ম হলো, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আগেরবার যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের সঙ্গে পরেরবার জন্ম নেওয়া জুটির বিয়ে হবে। অর্থাৎ একই সময় জন্ম নেওয়া দুই ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হওয়া নিষেধ। এটাই আদম (আ.)-এর শরিয়তের বিধান। কিন্তু এ নিয়ম মানতে নারাজ কাবিল। কাবিল জেদ ধরল তারই সঙ্গে জন্ম নেওয়া বোন আকলিমাকে বিয়ে করবে সে। আকলিমা ছিল দেখতে অপরূপ। রূপের কারণেই কাবিল তাকে হাতছাড়া করতে চাইল না। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী আকলিমার বর হওয়ার কথা তারই বড় ভাই হাবিলের। হাবিল বলল, হে ভাই আমার! তুমি আল্লাহর শরিয়ত লঙ্ঘন কোরো না। আমার জন্য আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। তুমিও তোমার তাকদির নিয়ে আনন্দিত থাকো।
হাবিলের এমন মধুর দাওয়াতেও কাবিল অনড়। বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া বাড়তে বাড়তে আদম (আ.) পর্যন্ত গড়াল। কাবিল নাছোড়বান্দা। হাবিলের পক্ষেও সম্ভব নয় শরিয়তের বাইরে যাওয়া। আদম (আ.) দেখলেন অবস্থা খুবই জটিল পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, এক কাজ কর; তোমরা দুজনই আল্লাহর রাহে কোরবানি কর। যার কোরবানি আল্লাহর রাহে কবুল হবে সে আকলিমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। তখন নিয়ম ছিল, কোরবানির জন্তু একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে রেখে আসতে হতো।
যার জন্তু বা সামগ্রী আসমানি আগুন এসে পুড়িয়ে ফেলত, তার কোরবানি কবুল হয়েছে ধরে নিত। আর যার জন্তু বা সামগ্রী অক্ষত রয়েছে তার কোরবানি গৃহীত হয়নি বলে বিবেচিত হতো। যেই কথা সেই কাজ। হাবিল কোরবানির জন্তু নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসে। হাবিলের সামর্থ্যমতো একটি পশু সে পাহাড়ের ওপর রেখে আসে।
অন্যদিকে কাবিল মোটাতাজা বড় একটি পশু রেখে আসে। কাবিল মনে করেছিল, দেখতে মোটাতাজা হলেই আল্লাহ সে পশু গ্রহণ করবেন। কিন্তু দেখা গেল, আল্লাহ হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন, কাবিলেরটা ফিরিয়ে দিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া) এ ঘটনাটি আল কোরআনে এভাবে বলা হয়েছে, ‘আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা দুজনই কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত ২৭) এখানে কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু মনের কথা বলা হয়েছে।
হাবিলের মধ্যে এটা ছিল তাই তাঁর কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। কিন্তু কাবিলের মধ্যে এর অভাব ছিল ফলে তার কোরবানি কবুল হয়নি। আমাদের মধ্যে যাদের কোরবানির সামর্থ্য আছে অবশ্যই হাবিল-কাবিলের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা যা-ই কোরবানি করি না কেন, তা যেন হয় লৌকিকতামুক্ত। কোরবানি শুধু হবে আল্লাহর জন্য। অনেকে কোরবানির পশু কিনে বলেন, এতে গোশত কম হবে। ঠকা হয়ে গেল। অথবা বলেন, কোনোরকম রক্ত ঝরাতে পারলেই হলো।
ভালো পশুর দরকার নেই। এসব চিন্তা সঠিক নয়। আপনার সামর্থ্য থাকলে আপনি সবচেয়ে দামি পশু কোরবানি করবেন। বিদায় হজে রসুল (সা.) ১০০ উট কোরবানি করেছিলেন। আর কোরবানি যেহেতু আল্লাহর জন্য হবে তাই পশুর গোশত কম হবে না বেশি হবে, গরু কিনে ঠকা হলো, জিত হলো এসব আলাপ না করাই ভালো। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন।
আপনার মন্তব্য লিখুন