বাংলাদেশ ব্যাংকের সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল (ইইএফ) থেকে বিনাসুদে নেওয়া ৮১২ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এ তহবিল থেকে ৫৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
এসব উদ্যোক্তা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণ নিয়েছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
২০০১ সালে ১০০ কোটি টাকা নিয়ে সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল বা ইইএফ গঠন করেছিল সরকার। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় ইইএফ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)। ২০০৯ সালের ১ জুন থেকে আইসিবি ইইএফ তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে।
২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সরকারের তহবিল থেকে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে ইইএফের জন্য। ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে আট বছর মেয়াদে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা বিনাসুদে ঋণ দেওয়া হয়।
এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯৩ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। বাকি ৮১২ কোটি টাকা তুলতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ মোট ঋণের ৮০ দশমিক ৫৯ শতাংশই অনাদায়ী রয়ে গেছে। এই অর্থ আদায়ের জন্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যাংক ও আইসিবি কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের হাতে থাকা অবধি এই তহবিল থেকে ১৮৩টি প্রকল্পে বিনিয়োগ হিসেবে ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্থ আইসিবির কাছে এই তহবিলের দায়িত্ব যাওয়ার পর ৩৯৪টি প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্প ব্যয়ের ৪৯ শতাংশ তহবিল থেকে বাকি ৫১ শতাংশ উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগ করতে হয়। উদ্যোক্তার নিজের অংশের বিনিয়োগের পরই ইইএফের অর্থ বিতরণ শুরু হয়।
বাংলাদেশে ব্যাংক ও আইসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তহবিলের নিয়ম অনুযায়ী, ইইএফ সহায়তার প্রথম কিস্তি ছাড়ের দিন থেকে পরবর্তী আট বছরের মধ্যে সমুদয় অর্থ তহবিলে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও ৮০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠান অর্থ ফেরত দেয়নি। আগামীতেও দেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, যাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সাংবাদিক রয়েছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীও রয়েছেন, যারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন। এর আগে ২০১৪ সালে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এই তহবিল নিয়ে একটি জরিপ করে ঋণ নেওয়া ১৬৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৭টির হদিস পায়নি।
জেনেই ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ: গত মে মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় জমা দেওয়া সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানকে ইইএফ থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে তার একটি অংশের অস্তিত্ব বাস্তবে পাওয়া যায়নি।
এমনকি এক সংস্থার নামে ঋণ নিয়ে অন্য সংস্থার কাজে ব্যয় হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জামানত হিসেবে যেসব জমির কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে তাও ভুয়া। এসব ঋণ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর কে কমোডিটিস লিমিটিড ২০০৪ সালে আট বছর মেয়াদে পরিশোধের শর্তে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ইইএফ ঋণ নেয়। যন্ত্রপাতি আমদানি করার কথা বলে ঋণ নিলেও বাস্তবে যন্ত্রপাতি আমদানি করেনি। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ঋণের অর্থ আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
২৯ লাখ ৬২ হাজার টাকায় কেনা জমি প্রতিষ্ঠানটি জামানত হিসেবে দেখিয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ফলে জমি বেচে টাকা উদ্ধার করার সম্ভাবনা নেই। আর যন্ত্রপাতি আমদানি না করায় যন্ত্রপাতি বিক্রি করেও ঋণের অর্থ তুলে নিতে পারবে না সরকার।
২০১০ সালে নোয়াখালী গোল্ড ফুডস লিমিটেডকে ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণে হিমাগার নির্মাণের জন্য ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি আমদানি না করে পুরো অর্থ লোপাট করেছে। এই ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
২০০৩ সালের মার্চে দি ডিকোড লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বমানের দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেটেড ফিল্ম বানানোর কথা বলে ৭ কেটি ৯১ লাখ টাকা বিনাসুদে ঋণ নেয়। উদ্যোক্তারা তখন বলেছিলেন, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
রাজধানীর ধানমন্ডির ৮/এ সড়কের ৮২ নম্বর বাড়িতে গড়ে ওঠা দি ডিকোড লিমিটেড বাস্তবে দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেটেড ফিল্ম বানায়নি, ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান তো দূরের কথা।
২০০৫ সালে রাজধানীর ৩০৭ এলিফ্যান্ট রোডের তৃতীয় তলার ঠিকানায় ড্রিমস সফট লিমিটেড ৮১ লাখ টাকা ঋণ নেয়। পরে ঠিকানা পরিবর্তন করে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়িতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় দেখানো হয়।
এখানে মূলত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব আহমেদের ভাই ও মা থাকেন। অর্থ নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যবসা গুটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
অমি মডার্ন প্রন হ্যাচারি লিমিটেডকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ ছাড়ের সময় দেখা যায়, অমি মডার্ন প্রন হ্যাচারির কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের কান্দাইলের ঠিকানায় দেওয়া জমির দলিলটি জাল।
সে কারণে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ অনুমতিপত্র বাতিল করা হয় ২০০৬ সালের অক্টোবরে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুমতিপত্র বাতিলের সেই আদেশ প্রত্যাহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়া হয়।
হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেডকে আনারসের জুস, ম্যাংগো পাল্প ও শাকসবজি সংরক্ষণের জন্য ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৮ বছর মেয়াদে ৬ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি কারখানা করেনি যন্ত্রপাতিও আমদানি করেনি, পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনেক আগের। তাছাড়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য করার সুযোগও নেই। তবে ইইএফ-এর যেসব জটিলতা ছিল তা নিরসনে ২০১৮ সালে তহবিলটি পুনর্গঠন করে ইক্যুইটি সাপোর্ট ফান্ড (ইসিএফ) করা হয়েছে।’
আপনার মন্তব্য লিখুন