স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেশে যেসব বিতর্কিত আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ অন্যতম। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে।
এরপর হঠাৎ করেই ‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক’-এর সদস্যরা শাহবাগ মোড়ে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর রাষ্ট্রীয় মদতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এটিকে বড় করা হয়। এমনকি বড় জমায়েত দেখাতে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানকে শাহবাগে যেতে বাধ্য করা হয়।
সচেতন মহলের দাবি, আধিপত্যবাদী ভারতের ইশারায় তৎকালীন আওয়ামী সরকারের জুডিশিয়াল কিলিংকে বৈধতা দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গড়ে ওঠে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। কিন্তু এক যুগ পর সেই সংগঠনটি আজ সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন। ওই আন্দোলনের সংগঠক ও কুশীলবরাও আজ অনেকেই প্রকাশ্যে নেই।
প্রথমদিকে গণজাগরণ মঞ্চের চরিত্র ‘নির্দলীয়’দাবি করা হয়। মঞ্চের নিরপেক্ষ চরিত্রটা শেষমেশ বজায় থাকেনি। বিএনপি ও জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যেই দাবি করেন, শাহবাগ একটা সাজানো নাটক। অবশেষে গণজাগরণ মঞ্চের আওয়ামী পরিচিতি দাঁড়িয়ে যায়। ছাত্রলীগ নেতারা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব নিয়ে নেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে হয় শাহবাগে ছুটে যাই।’ পরে আইন সংশোধন করে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয় এবং পরে একে একে সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়।
ওই সময় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক ও সংস্থা বিভিন্ন পত্রিকার নাম উল্লেখ করে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই হুমকির পর কতগুলো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরও করা হয়। ‘কৃত্রিম জনপ্রিয়তা’য় দেশের সব গণমাধ্যম বিষয়টিকে লুফে নেয়।
অনেকগুলো টিভি চ্যানেল এখানে-সেখানে টেবিল পেতে লাইভ ব্রডকাস্ট শুরু করে এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে। কিন্তু ওই সময় স্রোতের বাইরে গিয়ে আমার দেশ পত্রিকা শাহবাগীদের ফ্যাসিবাদী আচরণ তুলে ধরে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনামে ব্যানার লাইনে সংবাদ পরিবেশন করে। এর মাধ্যমে তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়েছিল আমার দেশ। এক পর্যায়ে পত্রিকা বন্ধ করা, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং পরে তাকে নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
এদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে ওই সময় যারা জিরো থেকে হিরো হয়েছিলেন, ওইসব কুশীলবের মধ্যে অন্যতম এর আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করা আলোচিত-সমালোচিত কথাসাহিত্যিক আওয়ামী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের সাবেক গভর্নর এবং ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের সাবেক ইমাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, ভারতপন্থি সাংবাদিক ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জিটিভির সাবেক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর অঞ্জন রায়, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি ও লেখক শাহরিয়ার কবির, মঞ্চের ‘স্লোগানকন্যা’খ্যাত লাকি আক্তার প্রমুখ।
তাদের অনেককেই এখন আর প্রকাশ্যে দেখা যায় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগ জুলাই বিপ্লবের আগে-পরে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তবে যে কজন বিদেশে যেতে পারেননি, তাদের দু-একজন ছাড়া এখন সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তাদের কে কোথায় আছেন, তা জানার প্রবল আগ্রহ রয়েছে দেশবাসীর। নিম্নে তাদের বর্তমান অবস্থান ও সংশ্লিষ্ট তথ্য তুলে ধরা হলো।
মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইমরান এইচ সরকার একজন সাধারণ চিকিৎসক থেকে রাতারাতি হিরো বনে যান। গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠলে সেটির মুখপাত্র তথা আহ্বায়ক হন। ওই সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাদিয়া নন্দিতা ইসলামকে বিয়ে করেছিলেন ইমরান। কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। ২০১৮ সালের দিকে বিচ্ছেদের খবর দেন নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই।
আওয়ামী লীগ সরকারকে শাহবাগের ফসল ঘরে তুলে দেওয়ার পর মঞ্চটিকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন ইমরান ও তার সঙ্গীরা। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এর কমিটি গঠনের কথাও জানা যায় তখন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে ‘মোটরগাড়ি’ মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র দুই হাজার ৭৭৫ ভোট পেয়ে জামানত হারান তিনি। অভিযোগ তোলেন ভোট কারচুপির। এরপর থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান ২০২২ সাল নাগাদ ঢাকাতেই ছিলেন। ধানমন্ডির বাসায়ই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। হাতেগোনা কজনের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এরপর ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে বিদেশে পাড়ি জমান। তবে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, বর্তমানে অতিগোপনীয়তা রক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন ইমরান।
ড. জাফর ইকবাল
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতায় আলোচিত-সমালোচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবদের অন্যতম। মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে বিগত দেড় যুগে ফ্যাসিবাদ শাসন ও জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পক্ষে যারা লেখালেখি করেন, তাদের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। পত্রপত্রিকায় এটিকে গৌরবান্বিত করে অসংখ্য নিবন্ধও লেখেন। সরাসরি মঞ্চে হাজির হয়ে আন্দোলনকারীদের ত্রাতা সেজেছিলেন। জুলাই বিপ্লবের পর তিনি কোথায় আছেনÑ তা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। জুলাই বিপ্লবের বিরোধিতা করে মতামত প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা জাফর ইকবালকে ক্যাম্পাসে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
বিপ্লবের পর মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার মামলায় জাফর ইকবালসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। গণহত্যায় উসকানিদাতা হিসেবে এই মামলায় জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিটি।
একটি সূত্র বলছে, জুলাই বিপ্লবের পর আত্মগোপন করে দেশের ভেতরেই অবস্থান করছেন তিনি। তবে অন্য একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, দীর্ঘদিন ঢাকায় আত্মগোপনে থাকার পর চলতি বছরের প্রথম দিকে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
শাহরিয়ার কবির
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির ছিলেন মঞ্চের কুশীলবদের অন্যতম। জুলাই বিপ্লবের পর ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন তিনি। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ‘নির্বিচারে হত্যা এবং লাশ গুম করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে করা মামলার অন্যতম আসামি শাহরিয়ার কবির।
দীর্ঘদিন থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যক্রম নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর তিনি কমিটির সভাপতি হন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি করা হয়। ছাত্রজীবন শেষে শাহরিয়ার কবির ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার সাংবাদিক এবং পরে তিনি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিগত সময়ে সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে কলংকিত করার ক্ষেত্রে শাহরিয়ার কবিরের ভূমিকা ছিল।
মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ
আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও কওমি অঙ্গনের বিতর্কিত আলেম ছিলেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। বিতর্কিত গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত হওয়ায় ‘শাহবাগী আলেম’ হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিতর্কিত কাজ হলো এক লাখ (কথিত) মুফতির স্বাক্ষর সংবলিত জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া। এ ছাড়া দেশের মূলধারার আলেমদের বিরুদ্ধে অবস্থান করতেন তিনি। বিশেষ করে জামায়াতের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।
সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর এবং ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম নিযুক্ত হন। কওমি-সংশ্লিষ্ট জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ ও ধর্মীয় দল বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি এবং ‘ইকরা বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদও পান।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর স্বাভাবিক দৃশ্যপট থেকে তিনি হারিয়ে গেছেন। সরকারি সব পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত আমার দেশকে বলেন, ফরীদ উদ্দীন শোলাকিয়ার ইমাম পদে নেই। তার ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি। তার কর্মস্থল দ্বীনি মাদরাসা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী আমার দেশকে জানান, ফরীদ উদ্দীন মাসউদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তিনি বারিধারার বাসায় থাকেন। মাদরাসা বা কোনো প্রোগ্রামে তার অংশগ্রহণের মতো অবস্থা নেই।
গত বছরের ৫ আগস্ট মিরপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি শিক্ষার্থী রিতা আক্তার (১৭) নিহতের ঘটনায় মাসউদের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় হত্যামামলা হয়।
‘লগি-বৈঠার খুনি’ বাপ্পাদিত্য বসু
ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের একজন। যশোরের সদর উপজেলার রুপদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় দুলাল চন্দ্র বসুর ছেলে বাপ্পাদিত্য বসুকে বেশিরভাগ মানুষই চেনেন ২৮ অক্টোবরের খুনি হিসেবে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছিলেন বাপ্পাদিত্য। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে বাপ্পাদিত্য বসু ব্লগার পরিচয়ে মঞ্চ থেকে আমার দেশসহ কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধের হুমকি দেন।
গত বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার তিন মামলায় বসুকে (৪০) গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর থেকে যশোর কারাগারে বন্দি রয়েছেন তিনি। অনেক আগে থেকেই যশোরের বাম-চরমপন্থিদের নিয়ে একটি বিশাল জঙ্গি গ্রুপ রয়েছে তার। ওই গ্রুপটি যশোর অঞ্চলে খুন-লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
বাপ্পাদিত্য ২০২৩ সালে ভারতপন্থি মিডিয়ার কল্যাণে বড় ব্লগার ও ‘শুদ্ধ তরুণ’ বনে যান। তার সহপাঠী কয়েকজন জানান, বাপ্পা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই মাদকাসক্ত ছিলেন। ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ার পর প্রকাশ্যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সে সময় চরমপন্থিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করেন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত যশোরে চরমপন্থিদের একটি গ্রুপের সঙ্গে বরাবরই যোগাযোগ রেখে চলেন তিনি।
‘স্লোগান কন্যা’খ্যাত লাকি আক্তার
‘স্লোগান কন্যা’ পরিচিতি পাওয়া লাকি আক্তার মঞ্চের সংগঠকদের একজন। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকির জন্ম ফেনীর সোনাগাজী থানায়। ওই সময় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ঘিরে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী, মদ, গাঁজার আসর জমানোসহ যত অপকর্ম হয়েছে- তার সম্মুখভাগে ছিলেন শাহবাগী ক্রীড়নক লাকিরা। অন্যদের মতোই দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকার পর গত ১২ মার্চ সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করতে গেলে পথে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় লাকির নির্দেশে পুলিশের ওপর হামলা চালায় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় মামলায় আসামি হিসেবে বামপন্থি কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের ১২ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর থেকেই ফ্যাসিস্টের দোসর শাহবাগী লাকিকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে সর্বমহলে। সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারীরা লাকিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে একের পর এক পোস্ট দেন। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেন তৌহিদী জনতা। এরপর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন লাকি।
লন্ডনে সিদ্দিকী নাজমুল
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হলে সরাসরি অংশ নেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। এর মধ্যে সম্মুখভাগে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে হঠাৎ করেই ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিদেশে চলে যান নাজমুল। সেই থেকে তিনি লন্ডনে অবস্থান করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ইস্যুতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করছেন। লন্ডনে বসেই নাজমুলের ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়েছে। নাজমুল আলমের একটি ফাঁস হওয়া স্ক্রিনশটের কথোপকথনে দেখা যাচ্ছে নাজমুল অন্য একজনকে নির্দেশনা দিচ্ছেন ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নাজমুল ভর্তির আগে শিবিরের ফোকাস কোচিং সেন্টার ও ছাত্রাবাসে থাকতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে যে সিন্ডিকেট জড়িত ছিল, তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি।
গণজাগরণ মঞ্চ ব্যবহার করে নাজমুল হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। বর্তমানে লন্ডনে তিনি ব্যবসায়িক ভিসায় অবস্থান করে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে, বর্তমানে সিদ্দিকী নাজমুল বিনিয়োগকারী ভিসায় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ব্রিটিশ সরকারের আইন অনুযায়ী, এই ভিসা পেতে ন্যূনতম দুই লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটির বেশি) বিনিয়োগ করতে হয়। ব্রিটেনে নাজমুলের বিলাসবহুল জীবন ও আর্থিক উৎসের নানা কাহিনি নিয়ে খোদ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যেই কানাঘুষা রয়েছে।
লন্ডনে তার বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, ফ্লেক্সফগ লিমিটেড, এলিট সিটি লিমিটেড, নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এসএনবি অটোস লিমিটেড, এসএনআর ইউকে বিডি লিমিটেড ও কার মিউজিয়াম লিমিটেড নামে ছয়টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ইস্ট লন্ডনের কেনন স্ট্রিট রোডে নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ নামের আবাসন ব্যবসার একক পরিচালক তিনি। যার মূলধন দেখানো হয়েছে সাড়ে আট লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় যা ১০ কোটি টাকার সমান।
সাংবাদিক অঞ্জন রায়
গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবদের মধ্যে গাজী টিভির এডিটর (রিসার্চ) অঞ্জন রায় ছিলেন সম্মুখভাগে। তিনি সরাসরি মঞ্চের মশাল মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার খাঁটি নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে পরিচিত অঞ্জন। শুধু তা-ই নয়, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সরাসরি এজেন্ট হিসেবে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সংগঠকদের মধ্যেও একজন তিনি। এই গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে যারা কোটিপতি হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম অঞ্জন রায়। এর আগে ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে অঞ্জন রায় ‘একুশের রাত’ অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনা করেন।
জুলাই বিপ্লবের পর থেকে অঞ্জন রায় আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বিপ্লবের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন তিনি। সম্প্রতি তার ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে পরিচিত অঞ্জন রায় ২০১৫ সালে ভারতীয় সৈন্যদের জন্য স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। ওই সময় শাহবাগ থানায় আযমীর বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন অঞ্জন।
পরে ‘র’-এর সরাসরি পরিকল্পনায় আযমীকে ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট বাসা থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকেই মূলত তিনি গুম ছিলেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার পর ‘আয়নাঘর’ থেকে ফেরেন এই সাবেক চৌকস সেনা কর্মকর্তা।
এসব শাহবাগী নেতা গণজাগরণ মঞ্চের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদা হিসেবে হাতিয়ে নেয়। বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে শাহবাগে বিরিয়ানির প্যাকেট, পানিসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করা হয়