রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর ম্যাসাকারের পরিকল্পনা আগে থেকেই জানতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তত্ত্বাবধানে। হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতের প্রশিক্ষিত একটি কিলার গ্রুপকে ঢাকায় আনা হয়।
এরা ভাড়া করা বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে মিলে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
রাজধানী পিলখানার সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম এই বিডিআর হত্যাকাণ্ড। আমার দেশ অনুসন্ধানে এ সম্পর্কে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতীয় কিলার গ্রুপের একটি অংশকে খেলোয়াড় বেশে বিডিআরের একটি পিকআপে করে এবং আরেকটি অংশকে রোগী সাজিয়ে নম্বরবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে করে পিলখানায় ঢোকানো হয়। রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে তারা পিলখানা ত্যাগও করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা ভারতীয় কিলার গ্রুপটিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বিমানের দুবাইগামী ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়।
এজন্য ফ্লাইটটি দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। আরও জানা গেছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকজন ও কিলার গ্রুপের সদস্যরা ফার্মগেটে অবস্থিত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের হোটেল ইম্পেরিয়াল ব্যবহার করেছে। নাম-পরিচয় গোপন রেখে ইম্পেরিয়াল হোটেলে তারা অবস্থান নিয়েছিলেন। পিলখানায় সংঘটিত ঘটনা ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ হিসেবে চালানো হলেও এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সেনাপ্রধান হিসেবে বিডিআর হত্যা মোকাবেলা তথা সেনা কর্মকর্তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। হত্যাকাণ্ডের দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পিলখানার সিসি টিভি ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করে দেন ঘটনার পরপর দায়িত্ব পাওয়া বিডিআর ডিজি লে. জেনারেল মইনুল ইসলাম। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটি ও জাতীয় তদন্ত কমিটির তদন্ত অসম্পূর্ণ রাখা হয়। ওই তদন্ত কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতার নাম এলেও শেখ হাসিনা তাদের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করতে দেননি এবং কমিটিতে এদের জিজ্ঞাসাবাদও করতে দেওয়া হয়নি।
সেনা তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বর্তমানে তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই তদন্ত সম্পর্কে। তিনি বলেন, তার নেতৃত্বাধীন তদন্ত সম্পর্কে এ মুহূর্তে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। কারণ ইতোমধ্যে তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন এবং সরকার বিডিআরের সাবেক ডিজি মো. জেনারেল আ ল ম ফজলুল রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। তিনি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছেন। তিনি বলেন, তারা আশা করছেন বর্তমান কমিশন বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উন্মোচন করবে।
আগে জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল সচিব আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে। তার মন্তব্যের জন্য ফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। সূত্র জানিয়েছে, তিনি সম্ভবত দেশে নেই।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনুসন্ধানে আমার দেশ আগের দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করেছে। তদন্ত কমিটি দুটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপ হয়। অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। ঘটনার সঙ্গে ওয়াকিবহাল এমন কয়েক ব্যক্তি ও সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। বিষয়গুলো স্পর্শকাতর হওয়ায় নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সেনা তদন্ত কমিটি এবং জাতীয় তদন্ত কমিটি দুটিতে বাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, আওয়ামী লীগ নেতা অনেককেই বক্তব্য দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। তাদের অনেকেই তদন্ত কমিটির সামনে আসেননি। কেউ কেউ এলেও তাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির সামনে আসা ও প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি তদন্ত কমিটিকে। ফলে বিডিআর হত্যা তদন্ত কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে দুই কমিটিতেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, বিডিআর হত্যাকাণ্ড ভারতীয় পরিকল্পনায় হয়েছে। শেখ হাসিনা যাতে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে পারেন সেটা পাকাপোক্ত করার জন্য তার সঙ্গে বোঝাপড়া করেই পরিকল্পনা করা হয়।
ভারত দেখেছে তারা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যখনই কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর জন্য তারা অনেক কিছুই করতে পারেনি। বিডিআর-এ সেনাবাহিনীর অফিসাররা কমান্ডে থাকায় সেখানে ভারতীয় বিএসএফ-এর ভূমিকা ম্লান ছিল। তাই তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনে এমন শক্তিশালী করবে যাতে সবকিছু তার হাতের মুঠোয় থাকে।
সেনাবাহিনী যাতে দুর্বল হয়ে যায়, বিডিআর নামে যাতে শক্তিশালী বাহিনী না থাকেÑ এ লক্ষ্যেই বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এর আগে নীলনকশা অনুযায়ী বিডিআর সদস্যদের হাত করা হয়। তারা যাতে সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে জন্য তথাকথিত ডাল-ভাত কর্মসূচি ও দুর্নীতির বিষয় এনে প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়।
চৌকস সেনা অফিসারদের হত্যার জন্য বিডিআর-এ বদলি করে এনে এক জায়গায় তাদের জড়ো করা হয়। এরপর তাদের হত্যা করা হয়। পদোয়া এবং রৌমারীর যুদ্ধে বিএসএফ হত্যার পর থেকেই বিডিআর ধ্বংসে নিয়োজিত হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। রৌমারীর ঘটনার নেতৃত্ব দেন রংপুরের তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার পরবর্তী সময়ে বিডিআর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। এরই ফল ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকেসহ ৫৭ সেনাকর্মকর্তা হত্যা।
সাহারা খাতুনের হোটেলে কিলার গ্রুপ
সূত্রে জানা গেছে, ফার্মগেটে অবস্থিত সাহারা খাতুনের হোটেল ইম্পেরিয়ালে এনে তোলা হয় ভারতীয় প্রশিক্ষিত একটি সন্ত্রাসী খুনি চক্রকে। ওই হোটেলে ‘র’-এর লোকজনও অবস্থান নেয়। ঘটনার দিন সকালে বিডিআর দরবার হলের সামনে একটি পিকআপ আসে খেলোয়াড়দের নিয়ে। বিডিআর-এর পিকআপে খেলোয়াড় বেশে ছিল কিলার বাহিনীর অনেক সদস্য। নম্বরবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে করেও আরেকটি গ্রুপকে পিলখানায় ঢোকানো হয়।
এরা আগে থেকে ভাড়া করা বিপথগামী বিডিআরদের সঙ্গে মিলে হত্যাকাণ্ড চালায়। বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিলের মৃত্যু এরা নিশ্চিত করে। দরবার হলের দক্ষিণ গেটে বিপথগামীদের সঙ্গে কিলার গ্রুপটি ছিল এবং এরা সকাল ১০টা সাড়ে ১০টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজিসহ ১৫ থেকে ১৮ জনকে হত্যা করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পিলখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আরেক দফা হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। বাইরের কিলার গ্রুপটি রাতে চারটি নম্বরবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে করে পিলখানা ত্যাগ করে। ধারণা করা হয় বিমানের দুবাই ফ্লাইটে এদের তুলে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় চ্যানেল কীভাবে বিডিআর ডিজি হত্যার খবর আগেই দিল?
বিডিআর ঘটনায় হতাহতের খবর তখনও জানাজানি হয়নি। এ অবস্থায় দুপুরেই ভারতের এনডিটিভিসহ দুটি চ্যানেলে খবর প্রচার করে যে বাংলাদেশে বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহে বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল এবং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। এ খবর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চ্যানেল কীভাবে প্রচার করে তা রহস্যজনক।
এ খবর যখন প্রচারিত হয় তখন প্রধানমন্ত্রী যমুনায় নিয়ে যান ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ জন কিলারকে। এদেরকে শেরাটন হোটেল থেকে খাবার এনে খাওয়ানো হয়। ঠিক এ সময়ে একদিকে ভারতীয় চ্যানেল বিডিআর ডিজির হত্যার খবর দেয়, অন্যদিকে পিলখানার ড্রেন দিয়ে বেরিয়ে আসে কর্নেল মুজিব ও কর্নেল এনায়েতের লাশ। ওই দিনই কিলার গ্রুপের একটি অংশ ভাড়া করা বিডিআর সদস্যদের নিয়ে জেনারেল শাকিলের বাংলোতে গিয়ে তার স্ত্রী ও অন্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই সময় বাংলোতে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন কর্নেল দেলোয়ার তার স্ত্রীকে নিয়ে। তারাও হত্যার শিকার হন। বাসার কাজের মেয়েকেও হত্যা করা হয়। জেনারেল শাকিলের স্ত্রীকে সবশেষে হত্যার করা হয় রান্না ঘরে নির্যাতন করে, নির্মমভাবে।
সেনা ও র্যাবকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি
সূত্র আরও জানায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ঘটনার খবর পেয়ে দশটার মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে র্যাবের একটি টহল দল। এই টহল দলটি তখন বেড়িবাঁধে টহলে ছিল। এরপর র্যাবের অন্য সদস্যরাও আসেন। কিন্তু পিলখানায় তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
মিরপুরে ফায়ারিং রেঞ্জে ছিল ৪৬ ব্রিগেডের একটি আর্টিলারি ইউনিট। এই ইউনিট প্রথমে আসে পিলখানার কাছে। কিন্তু তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। র্যাব এবং সেনা অগ্রদলটিকে তখন পিলখানায় ঢুকতে দেওয়া হলে ঘটনা এতদূরে গড়াত না। কারণ ভেতরে ডিউটিরত বিডিআর সদস্যদের কাছে যেসংখ্যক অস্ত্র ও গোলা বারুদ ছিল তার কয়েকগুণ বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল সেনাবাহিনী ও র্যাবের তাৎক্ষণিক আসা দল দুটির কাছে।
এরা ঢুকতে পারলে সহজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যেত। কিন্তু তাদের ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তখন পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। বিডিআর-এর কর্নেল রেজানুর ও কর্নেল শামস প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন। তারা ভেতরে ঢুকতে অনুমতি দেননি। অথচ সাংবাদিক মুন্নি সাহা দশটার পর থেকেই পিলখানার প্রধান গেটে গিয়ে বিডিআর-এর ডিএডিসহ জওয়ানদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এটিএন-এ লাইভ করেন। এতে ডাল-ভাত কর্মসূচির দুর্নীতির জন্য বিডিআর অসন্তোষ থেকে বিদ্রোহ হচ্ছে প্রচার করা হয়। এটাও রহস্যজনক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের প্রশ্ন সেদিন কেন র্যাবকে ঢুকতে দেওয়া হলো না, কেন সেনা অগ্রদলকে ঢুকতে দেওয়া হলো না, কেন মুন্নী সাহা ঘটনার পরপরই এমন উদ্দেশ্যমূলক খবর প্রচার করতে থাকলেন, বিদ্রোহীরা কেন নানক ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলবে না বলল, গোয়েন্দা সংস্থা কেন বলল তাদের কোনো গোয়েন্দা নজরদারি পিলখানায় ছিল না। প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যমুনায় যে ১৪ জন কিলারকে নেওয়া হলো তাদের সিলেক্ট করল কে? ডিজিএফআই পিলখানা প্রধান গেটের কাছে আমবালা মিষ্টির দোকানে ক্যাম্প করেছিল, তারা সেখানে কি কাজ করেছে? পিকআপে করে যারা দরবারের সামনে গেল তারা কারা ছিল?
পিলখানায় লাশ পোড়ানো ও গণকবর
পিলখানা হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল পরিকল্পনাকারীরা। দুটি লাশ তারা পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু পরে গণকবর খুড়ে লাশগুলো মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। ৩৩ ঘণ্টার লোমহর্ষক ঘটনার পর পিলখানা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এলে সেখানে একাধিক গণকবর থেকে লাশ তোলা হয়। সব লাশ গণকবরে চাপা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় ড্রেনেও ফেলে দেওয়া হয়। গুলি ছাড়াও কোনো কোনো লাশে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারার আলামত দেখা যায়। এই ঘটনায় ৫৭ সেনাকর্মকর্তার মধ্যে সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন। ১৭ জন ছিলেন বেসামরিক লোক। ৩ জন ছিলেন মহিলা। মেজর জেনারেল শাকিলের স্ত্রী, কর্নেল দেলোয়ারের স্ত্রী এবং একজন কাজের মেয়ে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসিরের অভিজ্ঞতা
বিডিআর ঘটনার পর পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে কনভেনর ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে ডেপুটি কনভেনর করে প্রথম তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটিতে সামরিক বাহিনী থেকে সদস্য দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী থেকে দেওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসিরকে।
ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির সেদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন আমরা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে যাই। এক পাশে গিয়ে বসি। সেনাবাহিনীর ‘ল’ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূর মোহাম্মদ ছিলেন, নেভির সদস্যও ছিলেন। এমন সময় দেখলাম, সাহারা খাতুন, কামরুল ইসলাম ও সচিব হাবিবুল আউয়াল (পরবর্তী সময়ে সিইসি) হাসতে হাসতে কক্ষে ঢুকলেন। তদন্ত নিয়ে কথাবার্তা নেই, অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছেন, চা বিস্কুট খাচ্ছেন।
এমন একটা ভাব যেন সব কিছু স্বাভাবিক। আমাদের আর সহ্য হলো না। আমি হাত উঠিয়ে বললাম আমার প্রশ্ন আছে। সাহারা খাতুন বললেন, বলুন। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না, জাতীয় তদন্ত কমিটি প্রশ্ন করতেই সবাই চুপ। সাহারা খাতুন বললেন, কেন আপনি জানেন না, এটা জাতীয় তদন্ত কমিটি? আমি বললাম, আপনি তো সাক্ষী দেবেন। আপনি তো পিলখানার ভেতরে গিয়েছেন ঘটনার পরপরই। ওখানে অফিসারদের মারা হয়েছে, গুলিবর্ষণ হয়েছে।
ভেতরে থাকা অবস্থায় ২ ঘণ্টায় কী দেখলেন আপনাকে বলতে হবে। এরপর সভা ভেঙে যায়। সচিব বললেন, চলেন আমরা পিলখানা পরিদর্শনে যাই। শেখ হাসিনার বুলেট প্রুফ গাড়িতে করে গেলেন সাহারা খাতুন, অ্যাডভোকেট কামরুল, আইজিপি, নানক, মির্জা আজম। পিলখানা ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় যাই। পরদিন ৩টায় বিডিআর অফিসার্স মেসে আমাদের বসার কথা।
সকালে শুনি কমিটি বাতিল হয়েছে। সচিব আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে নতুন তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমাকে রাখা হয়নি। এ ঘটনায় তরুণ অফিসারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। পরে আবার আমাকে কমিটিতে রাখা হয়। তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু সবকিছু আড়াল করার আলামত লক্ষ্য করলাম। জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশ্ন করতে চাইলাম কিন্তু প্রশ্ন করতে দেওয়া হলো না। পরে যে রিপোর্ট তৈরি হলো সেটা দায়সারা একটা রিপোর্ট ছিল। আমি এর সঙ্গে একমত হলাম না। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও তাপসের বিডিআরের পোশাক সংগ্রহ
পিলখানা ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল রহস্যজনক। বিডিআর প্যারেডের আগে থেকেই কিছু ঘটনা ঘটছে। ২২ ফেব্রুয়ারি একটি লিফলেট বিতরণ হয়েছে। পিলখানার সর্বত্র লিফলেট লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে দুটি অস্ত্র খোয়া যায়। শোনা যায়, ফজলে নূর তাপস বিডিআর-এর ২৫টি পোশাক বানিয়ে বাইরে নিয়ে গেছেন।
কিন্তু এসব কিছুই জানত না ডিজিএফআই। মেজর জেনারেল মোল্লা আকবর ওই লিফলেট পাওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। পরে বলেছেন, আমাদের এজেন্ট পিলখানার ভেতরে ছিল না। এতবড় একটা ঘটনা ঘটল আর তিনি জানেন না বা তাদের লোক নিয়োজিত করেননি তা কি বিশ্বাসযোগ্য? আসলে গোয়েন্দা ব্যর্থতার চেয়ে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ডিজিএফআইয়ের একটি অংশও এই চক্রান্তের সঙ্গে ছিল তখন।
আনসারের ডিজি কেন অস্ত্র নিয়ে গেলেন?
প্রধানমন্ত্রীর প্যারেডে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি প্যারেডে তৎকালীন আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এটিএম আমিন সৈনিকসহ অস্ত্রসহ গেছেন। তার গাড়িতে অস্ত্র ছিল। প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরে যে এমন ঘটনা ঘটবে তিনিও কি জানতেন?
ব্ল্যাংক অ্যামুনেশন কোথায় থেকে এলো?
ঘটনার দিন বিপুল ব্ল্যাংক ফায়ার হয়েছে পিলখানায়। ব্ল্যাংক অ্যামুনেশন ট্রেনিংয়ে ব্যবহার হয়। পিলখানায় ব্ল্যাংক অ্যামুনেশন থাকার কথা নয়। এত ব্ল্যাংক অ্যামুনেশন কোথা থেকে এলো এটাও রহস্যজনক।
পিলখানায় গার্ডের দায়িত্বে বিডিআরের যারা ছিলেন তাদের হাতে যেসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল বাইরে অপেক্ষমাণ সেনাবাহিনীর টিম ও র্যাবের কাছে। পিলখানায় বড়জোর ৩-৫ হাজার গুলি ছিল ডিউটিরতদের কাছে। আর বাইরে সেনাদল ও র্যাবের কাছে ছিল ১০ হাজারের বেশি গুলি। এদের ঢুকতে দেওয়া হলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারত।
বিডিআর নাম বদলে বিজিবি করার ষড়যন্ত্র
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর এ বাহিনীর নাম পাল্টানোর প্রথম দাবি তুলেন মেজর জেনারেল (অব.) সিআর দত্ত। তিনি এখন প্রয়াত। এরপর বিডিআরের ডিজি হিসেবে যোগদান করেন লে. জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম। তিনি বিডিআর-এর পোশাক পরেননি। সেনা বাহিনীর পোশাক পরে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতীয়রা বিডিআর-এর নাম পাল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে আসছে অনেক আগ থেকে। সেটা তার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। এমনকি বিডিআর-এর নাম বিজিবি করার আগেই তিনি বিজিবির নাম লিখে ঈদকার্ড ছাপিয়ে বিতরণ করেন।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট টেম্পারিং
বর্তমানে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল রফিক বিডিআর ঘটনার তদন্ত কমিটিতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট টেম্পারিং করেছেন। অর্থাৎ প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার কাজ করেছেন। শেখ হাসিনার সরকার তাকে ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে বিডিআর ডিজি করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার তাকে রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান করায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের শহীদ পরিবার এবং সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বিডিআর হত্যাকাণ্ড মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার ব্যাপারে যার সংশ্লিষ্টতা আছে তিনি কি করে এ আমলে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান হন?
আইসিটিতে শেখ হাসিনা গংসহ সুনির্দিষ্ট ৫৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের
পিলখানা হত্যাকান্ডে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানরা ওই বর্বরোচিত ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) আবেদন করেছেন। জানা গেছে, আবেদনে তারা শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামসহ তাদের সঙ্গে আরো যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনা ছাড়াও রয়েছেন মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম।
অভিযুক্ত সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ, ডিজিএফআই’র সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, মেজর জেনারেল (অব.) মামুন খালেদ, ইমরুল কায়েস, এনএসআই-এর তৎকালীন ডিজি, র্যাবের তৎকালীন ডিজি, ডিডিজি, ডাইরেক্টর অপারেশন, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, পুলিশের তৎকালীন আইজি নূর মোহাম্মদ প্রমুখ। শহীদদের সন্তানরা মনে করছেন, পিলখানা হত্যাকান্ডে ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী ও পুলিশের অসৎ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ ছিল।