দলীয় কর্মী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময় সভায় ডেকে আলোচনা না করেই সংবাদ সম্মেলন করায় হট্টগোল শুরু হয়। পরে সংবাদ সম্মেলন শেষ না করেই সভাস্থল ত্যাগ করেন দলের এই শীর্ষ নেতা। তার সঙ্গে অন্য সিনিয়র নেতারাও বেরিয়ে যান। বের হওয়ার সময় হট্টগোলে পড়েন দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য।
বুধবার বেলা ১১টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময় সভা হওয়ার কথা ছিল। সেখানে সাবেক নেতারা উপস্থিত থাকলেও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার কারণে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠক সূত্র মতে, সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময় সভার জন্য ডেকে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা শুরু করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এসময় ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা হট্টগোল শুরু করেন। সাবেক নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, আমাদের ডেকেছেন, আগে তো আমাদের কথা শুনবেন। আলোচনা করবেন। সেটা না করেই আপনি মিডিয়ার সামনে কথা বলা শুরু করেছেন। আমাদের ডেকে এনে কেন সংবাদ সম্মেলন করছেন?
তার আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাককে সভাস্থলে দেখে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা চিৎকার দিয়ে ওঠেন, তিনি এখানে কেন? তার ছেলে কেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট করেছেন, সেটিও জানতে চান সাবেক নেতারা।
অন্যদিকে সাবেক নেতাদের হট্টগোলের কারণে সংবাদ সম্মেলন শেষ না করেই তার অফিসে চলে যান ওবায়দুল কাদের। তখন সাবেক নেতারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের নিচ তলায় ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেন তারা।
কোন্দল মেটাতে ঢাকায় বৈঠক ডাকছে আওয়ামী লীগ
টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ অনেক জেলা-উপজেলায় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ সংসদীয় আসনেই নানা শাখা-উপশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলীয় নেতা-কর্মীরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবার নড়েচড়ে বসেছে হাইকমান্ড। ক্ষমতার আধিপত্য, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে একতা ফিরিয়ে আনতে ঢাকায় তলব করা হচ্ছে জেলা-উপজেলার নেতা এবং দলীয় সংসদ সদস্যদের।
জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। দলীয় প্রধানের নির্দেশনার পর তৎপর হয়ে উঠেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলাকে ডাকার সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এ বৈঠক হবে বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগামী বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের হলরুমে চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন সব জেলা/মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দলীয় সংসদ সদস্য, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে।
সেখানে তৃণমূলে দল অধিকতর গতিশীল করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ চট্টগ্রাম বিভাগীয় টিমের সব কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।’ বিএনপি অংশ না নেওয়ায় গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলাই ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এমন প্রেক্ষাপটে দলটির মধ্যে যারা ভোটে দাঁড়াতে আগ্রহী, তাদের সবাইকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দল থেকেও প্রতি আসনে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
এর ফলে তৃণমূলে কোন্দল বাড়তে থাকে, যা নির্বাচনের আগে এবং পরে অনেক জায়গাতেই সহিংসতায় রূপ নেয়। এ ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এমনকি নির্বাচনের পৌনে দুই মাস পর এসে এখনো বিভিন্ন জেলায় বিভেদ দৃশ্যমান হচ্ছে, বিশেষ করে যেসব আসনে নৌকার প্রার্থীরা একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতেই তৃণমূলের কোন্দল ও বিভক্তি নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচনসহ নানা কারণে অনেক স্থানে অভ্যন্তরীণ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সম্মেলন না করা, সম্মেলন হলেও কমিটি না দেওয়ায় সাংগঠনিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কোন্দল নিরসন ও সাংগঠনিক গতি বাড়াতে জেলা নেতাদের ঢাকায় ডাকা হচ্ছে। রমজান মাস শুরু হলেই ধারাবাহিকভাবে বেলা ১১টা থেকে বৈঠক শুরু করে ইফতারের পর শেষ করা হবে।
এখন কাজগুলো গুছিয়ে রাখছি।’ সারা দেশে আওয়ামী লীগের আটটি বিভাগীয় কমিটি রয়েছে। মূলত এসব কমিটির মাধ্যমেই তৃণমূলের বিরোধ মেটানোর পরিকল্পনা করেছে দলটি। কিন্তু তৃণমূলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির পক্ষে সেটি পুরোপুরি দূর করা কঠিন হবে। রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তুলনামূলক খুবই কম। এরপরও দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে দু-তিনটা জেলাকে ঢাকায় ডাকা হতে পারে।’
বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে গণভবনে বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর আর কোন্দল থাকার কথা নয়। তারপরও আমরা খোঁজখবর রাখছি। সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনে ঢাকায় ডেকে কোন্দল নিরসন করা হবে।’
সূত্রমতে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল ভোটের মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়া। দলের এ সিদ্ধান্তের কারণে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল- সব স্তরের নেতারা এবার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান।
এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে ৩৫০-এর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যার মধ্যে ২৬৯ জনই ক্ষমতাসীন দলের। প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও নাজুক হয় নির্বাচনের পর।
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। এ নিয়ে বিরোধ এখনো কাটেনি। সর্বশেষ ভোটকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলা-উপজলো নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে। মার্চ থেকেই ঢাকায় ডাকা হবে জেলা নেতাদের।
আমরা শক্তিশালী সংগঠন দেখতে চাই। সাংগঠনিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, তবে তা যেন প্রতিহিংসায় পরিণত না হয় সেজন্য দিকনিদের্শনা দেব।’
আপনার মন্তব্য লিখুন