২০১৮ তে আমি যখন চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই, তখন সত্যি বলতে আমি এইসব আর এতসব চক্রান্ত আর কান্ডকীর্তির কিছুই তেমন জানতাম না। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে টের পাচ্ছিলাম কোথাও কিছু একটা মিলছে না, কি যেন একটা কিছু ঠিক নেই।
বাবা আর্মিতে ছিল আর আমিও আমার টিনেজেই আর্মিতে জয়েন করি। তাই সোলজারিং এর বাইরে তেমন কোনো আহামরি স্কিল ডেভেলপ করেনি। তাই হুট করে চাকরি ছাড়ার ডিসিশনটা বেশ কঠিনই ছিল। কিন্তু ছাড়ার পর কখনও ‘কেন ছাড়লাম?’ ভেবে আফসোস হয়নি।
সোলজারিং কে গুডবাই বললেও আর্মিকে ভাল না বাসবার কিংবা ঘৃণা করবার কোনো কারন কখনই ছিল না আর হবেও না, ইনশাআল্লাহ। কারন আর্মির পর কর্পোরেট আর এনজিওতে চাকরি করার সুবাদে আমি জানি, প্রফেশনালিজমের দিক থেকে আর কোনো সেক্টর বা ইন্ডাস্ট্রি আর্মির ধারেকাছেও নেই। সকাল ১০ টার ভেতর আর্মিতে যে পরিমান কাজ হয়, তা বাকিরা সারাদিনেও করেনা। তাই ‘আর্মি ইজ দ্য বেস্ট’ দেখতে, ভাবতে, শুনতে সবসময় ভাল লাগে। আর সেকারণেই আর্মিকে ডিশেইপড অবস্থায় দেখলে কষ্ট হয়।
আর্মির কিছু ব্যাপার আর্মির বাইরের কাউকে বোঝানো মুস্কিল। যেমনঃ কমরেডশিপ। জিনিসটা আত্মীয়তাও না আবার ফ্রেন্ডশিপও না, একেবারে অন্যকিছু। আবার যেমনঃ এস্প্রিত দে কো, এক কিসিমের শেয়ারড ফিলিংস, ব্যাখ্যা করা কঠিন।
ভারতীয় জেনারেল জে পি কালার একটা বই আছে নাম ‘ডিমিস্টিফাইং মিলিটারি লিডারশিপ।’ সেই বইয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সোলজারদের ব্যাপারে দারুণ কিছু কথা লিখেছেন উনি।
প্রথমে উনি ক্লিয়ার করেছেন যে, ‘ইজ্জত’ একটা পিউর ভারতীয় উপমহাদেশের শব্দ যেটার সঠিক ইংরেজি নেই। বিশ্বযুদ্ধেও ভারতীয় উপমহাদেশের সোলজাররা অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তারা রানী বা ইউনিয়ন জ্যাক (বৃটিশ জাতীয় পতাকা) এর জন্য যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ দেয়নি। বরং ভারতীয় উপমহাদেশের সোলজারেরা লড়ে আর প্রাণ দেয় নিজেদের পল্টন আর নিজেদের কমান্ডারের ইজ্জতের কথা ভেবে।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলও বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আর আমাদের বাংলাদেশের সোলজাররাও নিজেদের পল্টন আর নিজেদের কমান্ডারের ইজ্জতের কথা ভেবে লড়তেই অভ্যস্ত। আর্মির কোনো ইউনিটের সাথে জীবন যাপন না করে থাকলে, এই জিনিস উপলব্ধি করা অসম্ভব।
জেনারেল আজিজ আর জেনারেল শফির পর জেনারেল ওয়াকার রিটায়ার্ড মিলিটারি ফ্র্যাটার্নিটির জন্য এক ধরনের রিলিফই ছিল বলা চলে। আমি উনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা, কখনো তার আন্ডারকমান্ডও ছিলাম না। আমার ধারনা, তার ৫ ই আগস্টের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে কয়েকটা লাইন তার জন্য বরাদ্দ থাকবে এবং তার এতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। কারন এরপর বাংলাদেশের মানুষ যা চায়, তাতে তার কন্ট্রিবিউট করার অপশন তেমন নেই বললেই চলে, দরকারও নেই বলে মনেকরি। টাইমলি ইলেকশন হবে, আর্মি ব্যারাকে ফিরে যাবে, আর উল্ফল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখবে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে আর্মি সারাদেশ জুড়ে ডেপ্লয়েড। মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে এবার, শুনতে এডভেঞ্চারাস লাগলেও আর্মি আদতে এইসব ননমিলিটারি পাওয়ার টাওয়ার এঞ্জয় করেনা মোটেই। তাদের কাছে এক্টিভ ডিউটিতে থাকা অবস্থায় অলরেডি যে মিলিটারি অথরিটি আর পাওয়ার থাকে তাই মোর দ্যান কাফি। বরং পুলিশি কাজকাম তাদের বেশিরভাগেরই নাপছন্দ। আমি নিজেও ইউনিফর্মে থাকা কালে কখনও এসব লাইক করিনি।
ফৌজে লাইফ মানে শৌর্য, বীর্য, ক্ষিপ্রতা, সম্মান, গৌরব ইত্যাদি আর সেই সাথে আমার আর্মি, আমার ইউনিট দি বেস্ট। বাংলাদেশের এক কণা মাটি দখলের চেষ্টা করলে দিল্লি-রেংগুন গুড়ায়া ফেলব, এই হল জোশ। এর ভেতর ম্যাজিস্ট্রেসি ফেজিস্ট্রেসি এসে ঢুকলে কনফিউজড লাগে, স্ট্রেসড লাগে।
যাহোক, র্যাব হবার পর থেকেই সম্ভবত আর্মি পুলিশিং শেখা শুরু করল। আর পুলিশ শিখল আর্মির মত র্যাংক, সার্ভিস ড্রেস, কমান্ড স্টিক ক্যারি করা। পুলিশিং শিখবার পাশাপাশি র্যাবে যাওয়া আর্মি অফিসারদের মারফত বাকিরাও শিখতে শুরু করল কিভাবে পুলিশ তাদের পলিটিক্যাল মাস্টারদের সার্ভ করে, ম্যানেজ করে আর বিনিময়ে নিজেদের আখের গুছায়। পলিটিশিয়ানদেরও আর্মি নিয়ে যে দ্বিধা ছিল তা উবে গেল। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তো আর সম্ভব না তাই ক্যান্টমেন্টের বাইরে পোস্টিং করিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো মিসইউজ করার ট্রেন্ড চালু হল।
কুখ্যাত বরখাস্ত মেঃ জেঃ জিয়ার উদাহরণ বাংলাদেশের মিলিটারি হিস্ট্রিতে হিস্ট্রি হয়েই থাকবে। সেই যে মেজর র্যাংকে উনি আর্মির বাইরে গেলেন তারপর আর ফেরেননি, সোজা জেলে গেসেন। তিনি পুলিশিং এ যাবার পর তার এভারেজ মিলিটারি থিংকিং এন্ড প্ল্যানিং ক্যাপাসিটি (আমি শিউর না উনি স্টাফ কলেজ করা কিনা) নিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ ব্রুটালিটির ডেফিনিশন চেঞ্জ করে ফেলেছিলেন এবং নরহত্যায় রেকর্ড করেছেন। আল্লাহ তাকে উপযুক্ত প্রতিদান দিন।
কিন্তু বাস্তবতা হল, তিনি একা এইসব কাজ করেননি। পলিটিক্যাল মাস্টারস পুলিশ সাপোর্টারস ছাড়াও তারই মত নৃশংস কিছু অফিসারও ছিল তার এসব জঘন্য অপরাধের সংগী। গত ৮ আগস্ট আইসিটি আর্মির যাদের বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে, তাদের ভেতর জিয়া-২, জিয়া-৩ অথবা জিয়া-৪ কারা তা জানা এবং তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সময়ের দাবী।
তাহলে এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এত হৈচৈ হচ্ছে কেন? বরখাস্ত মেঃ জেঃ জিয়ার সময় তো কেউ আপত্তি করেনি। ঠিক এইখানটায়ই আমাদের একটু পজ দিয়ে রিথিং করতে হবে।
কোনো সার্ভিং অফিসার কিংবা সোলজারই চায় না জিয়া গ্রেডের কেউ তার পল্টনে কিংবা আর্মিতে থাকুক। সে আর্মির বাইরে ছিল, আকাম করেছে এবং কট খেয়েছে। নান অফ দেয়ার বিজনেস। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে ইউনিফর্ম পরিধান করা কাউকে তার অপরাধ প্রমানের পূর্বে আপনি মাথায় হেলমেট আর হাতে হাতকড়া পড়িয়ে বের করে নিয়ে যাবেন, এইটা তাদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন।
কারন নম্বর ১, এইটা তাদের ইজ্জতে লাগে। আর কারন নম্বর ২, তাদের জন্মাবধি শেখানো হইসে, তারা চলে আর্মি এক্টের অধীনে, আর্মি রুলস আর রেগুলেশনের কারনে আম জনতার মত সব সাংবিধানিক অধিকার তাদের নাই। এটা মেনে নিয়েই তারা চাকরি করে। আর তাই তাদের ভেতর কেউ অপরাধ করলে তার বিচার আর্মির আইনে হবে আর হয় বলেই তারা এদ্দিন জানত।
খুন আর বলাতকারের মত কিছু অপরাধ আছে যার শাস্তি আর্মির আদালতে হয়না। কিন্তু সেই বিচারের আগে আর্মির সিস্টেমে অপরাধীকে আর্মি থেকে বের করে দেয়া হয়, এমনটাই তারা জানে।
যাহোক, এখন তারা জানে এমন কিছু অপরাধ আছে যা আর্মির বাইরের কোর্টেই বিচার হবে, যে অপরাধ করার সময় অভিযুক্ত বা অপরাধীর গায়ে আর্মির সবুজ উর্দি ছিল না। তারাও সেসব অভিযুক্তদের সুবিচার চায় এবং বিচার শেষে অপরাধীদের শাস্তি দেখতে চায়। কিন্তু ইউনিফর্মড অফিসারদের হাতকড়া পড়িয়ে প্রিজন ভ্যানে করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরুতে হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখতে তারা রাজি না। তারা জানতে চায় কলকাতা আর দিল্লিতেও কি একই ওয়ারেন্টের কপি গেছে? এই লিস্টে সব আর্মির লোকই কেন? দেশের সব আকাম আর দুর্নীতি কি খালি আর্মিই করল এদ্দিন?
তারা জানেও না যে, হাতকড়া পড়ানো মাস্ট না আর কাউকে হাতকড়া পড়াতে হবে কিনা সেই ডিসিশন কোর্টের না বরং পুলিশের হাতে। তারা আইনের মারপ্যাচ বুঝেনা। কারন তাদের কাছে তাদের পল্টন আর কমান্ডারদের ইজ্জত সবার উপর। এই ওয়ারিয়র স্পিরিট আর ইথোজ নন নেগোশিয়েবল। যুদ্ধ লাগলে এই ইজ্জতের দায়েই সে শত্রুর সবচে ভাল মানুষটাকেও নির্দ্বিধায় মেরে ফেলে।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের আর্মি তাদের ইতিহাসের সবচে নাজুক সময় পার করছে। আর্মি কমান্ডারদের স্ট্রেস লেভেল এখন সুপার হাই থাকবার কথা। কারন যেকোনো দেশের আর্মি বাচে সেদেশের জনগণের ভালবাসায়। জনগন ভাল না বাসলে সৈনিকের বয়েই গেছে হাতেগোনা বেতন আর কয়েক আউন্স লোহা দিয়ে বানানো মেডেলের জন্য জান দিতে। অবশ্য আমাদের সম্ভাব্য শত্রুরা নিশ্চয়ই এমন সময় যারপরনাই খুশী। কারন একটা বুলেট খরচা নাই অথচ পুরা আর্মির মোরাল ডাউন, জোশ নাই করে দেয়া গেছে।
টাইটরোপের উপর দিয়ে হাটছেন জেনারেল ওয়াকার এবং তার সাথে তার আর্মিও। হাতকড়া প্রিজন ভ্যানের মজা দেখার অপেক্ষায় যারা উদগ্রীব অপেক্ষায় আছেন, তাদের জন্য আরো কি কি মজা অপেক্ষা করছে, তা আল্লহই মালুম।