সব অনুমান সত্যি করে অস্কার মঞ্চে ঝড় তুলেছে ‘ওপেনহাইমার’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যানহাটন প্রজেক্টের’ প্রধান বিজ্ঞানী জে রবার্ট ওপেনহাইমারকে নিয়ে নির্মিত এ সিনেমা জিতে নিয়েছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ৯৬তম আসরে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার।
রবিবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল) যুক্তরাষ্ট্রের লস-অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে ছিল ব্রিটিশ নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানের এ সিনেমার জয়জয়কার।
নোলান পেয়েছেন সেরা পরিচালকের পুরস্কার। অভিনেতা কিলিয়ান মার্ফি পেয়েছেন সেরা অভিনেতার অস্কার।
এ ছাড়া পার্শ্ব-অভিনেতা শাখায় রবার্ট ডাউনি জুনিয়র জিতে নিয়েছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা নির্মাতা, সেরা অভিনেতা, সেরা পার্শ্ব-অভিনেতা ছাড়াও সম্পাদনা, সিনেমাটোগ্রাফি, সেরা মৌলিক সুর মিলিয়ে সাতটি অস্কার জমা হয়েছে ‘ওপেনহাইমার’-এর ঝুলিতে। মনোনয়নে এ সিনেমাটি জায়গা করে নিয়েছিল মোট ১৩ শাখায়।
এবারের আসরে সেরা অভিনেত্রী হয়েছেন এমা ওয়াটসন। ‘পুওর থিংস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি এ পুরস্কার পান।
অস্কার : ২০২৪ এর সকল খুটিনাটি
৯৫ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের পর্দা নামলো ১২ই মার্চ। বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন এই দিনের জন্য। হলিউডের ডলবি থিয়েটারে জমজমাট এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সোনার মূর্তি জিতে নিলেন বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা।
এই পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকা ঘোষিত হয়েছিল গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি। এবারে ১১টি বিভাগে মনোনীত হয়ে সর্বোচ্চ ৭টি বিভাগে পুরস্কার জিতে নিয়েছে ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’। সেরা অভিনেতা বাদে প্রধান সব ক্যাটাগরিতেই এই সায়েন্স ফিকশন মুভির আধিপত্য দেখা গেছে। আবার ৯টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েও খালি হাতেই ফেরা লেগেছে ‘দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন‘কে। বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্র হবার পাশাপাশি ৪ বিভাগে অস্কার বাগিয়েছে জার্মানির ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট‘। ৯৫ তম অস্কার অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের নিয়ে রোর বাংলার আজকের এই আয়োজন।
সেরা চলচ্চিত্র
বরাবরের মতোই সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কার জমিয়ে রাখা হয়েছিল শেষ মুহূর্তের জন্য। তবে ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ এর বিজয় কাউকে খুব একটা চমকাতে পারেনি। এই বিভাগে ‘টার’ কিংবা ‘দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন’ এর মতো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও অ্যাওয়ার্ড সার্কিটে এশিয়ান চরিত্রপ্রধান চলচ্চিত্রটির একতরফা আধিপত্য আগেই এর পুরস্কার নিশ্চিত করে দিয়েছিল। এটোয়েন্টিফোর স্টুডিওর এই মুভিকে মাল্টিভার্সভিত্তিক কাহিনীর জন্য সায়েন্স ফিকশন জনরায় ফেলা হলেও আদতে এটা ফ্যান্টাসি, কমেডি, ফ্যামিলি ড্রামা মিলিয়ে জনরাবেন্ডিং এক সৃষ্টি।
মাত্র ১৪ মিলিয়ন ডলারের মুভিটি বক্স অফিসে সফল হবার পাশাপাশি ৭টি বিভাগে অস্কার জিতে সর্বকালের সেরার তালিকায় জায়গা করে নিল। এ বিভাগে মনোনীত অন্যান্য চলচ্চিত্র ছিল অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, অ্যাভাটার – দ্য ওয়ে অব ওয়াটার, দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন, এলভিস, দ্য ফ্যাবলম্যানস, টপ গান: ম্যাভেরিক, টার, ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস, এবং উইম্যান টকিং।
সেরা পরিচালক
এ বিভাগের পুরস্কারটি জিতে নিয়েছেন ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ মুভির পরিচালক ডুয়ো। এর আগে ‘সুইস আর্মি ম্যান’ দিয়ে তাদের ভিন্ন ঘরানার নিমার্ণের সাথে আগেই কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল দর্শকের। তবে এবার ড্যানিয়েল কুয়ান, ড্যানিয়েল শাইনার্ট মিলে যা দেখালেন, তা আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন মার্টিন ম্যাকডোনাহ, স্টিভেন স্পিলবার্গ, রুবেন আস্টলান্ড এবং টড ফিল্ড। ‘দ্য ফেবলম্যানস’ এর কারণে স্টিভেন স্পিলবার্গের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেছিলেন অনেকে, তবে তার নিজ জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত মুভিটি আদতে সেভাবে ক্লিক করেনি। আবার ‘দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন’ এর অসাধারণ নির্মাণ এবং আগের ইতিহাসের কারণে মার্টিনকেও সম্ভাব্য বিজয়ী মনে করেছিলেন কেউ কেউ। তবে এই বাঘা বাঘা পরিচালকদের পিছে ফেলে সোনার মূর্তিটা দুই ড্যানিয়েলের ঘরেই গেছে।
সেরা অভিনেতা
এ বছর বহুল আরাধ্য সেরা অভিনেতার অস্কারটি জিতেছেন ব্রেন্ডন ফ্রেজার। মূলত ‘দ্য মমি’ সিরিজের জন্য বিখ্যাত হলেও নব্বই এবং শূন্য দশকে বেশ কিছু চমৎকার চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির কুপ্রভাবে আচমকা হলিউডে ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যান তিনি। সাথে নিজের শারীরিক সমস্যা তাকে ফেলে দেয় ঘোর বিষণ্নতায়। আস্তে আস্তে ‘ডুম পেট্রল’ সিরিজ এবং অন্যান্য চরিত্রের মাধ্যমে ফিরে আসেন তিনি। অবশেষে অবশ্য তার উত্থান রাজার মতোই হলো। ‘দ্য হোয়েল’-এ মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা স্থূলকায় এক মানুষের ভূমিকায় তিনি যে আবেগঘন পারফরম্যান্স দিয়েছেন, তার সাথে আসলেই কিছুর তুলনা হয় না। এ বছরের বড় বড় সব অ্যাওয়ার্ডই জিতে নিয়েছেন তিনি। এ বিভাগের মনোনীত অন্যেরা হলেন অস্টিন বাটলার, কলিন ফ্যারেল, বিল নাইহি, এবং পল মেসকাল। কিংবদন্তী এলভিস প্রিসলির ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য অস্টিনও ফ্রন্টরানার ছিলেন এই বিভাগে।
সেরা অভিনেত্রী
এ বিভাগের পুরস্কারটি গেছে মালয়েশিয়ান অভিনেত্রী মিশেল ইয়োর ঘরে। অ্যাকাডেমির ৯৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো এশিয়ান অভিনেত্রী জিতলেন এই পুরস্কার। নব্বই এবং শূন্য দশকে বিভিন্ন অ্যাকশন এবং ড্রামা মুভির জোরে বিশ্ব চলচ্চিত্রে বেশ ভালোমতোই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তিনি। তার ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ মুভিটি বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারও জিতেছিল। কিন্তু সম্প্রতি হলিউডের নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে তার ক্যারিয়ারে ভাটা পড়ে যায়। নিজের যোগ্য ভালো কোনো চরিত্র আসছিল না তার কাছে। ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ কিন্তু সামান্য কোনো সায়েন্স ফিকশন কমেডি নয়, মিশেল ইয়োর পুরো ক্যারিয়ারের একটা বড় মন্তাজও বটে। এ বিভাগে মনোনীত অন্যেরা হলেন মিশেল উইলিয়ামস, আনা ডি আর্মাস, আন্দ্রেয়া রাজেনবোরোহ এবং কেট ব্ল্যানচেট। এর মাঝে কেট এবং মিশেলের মাঝে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা আগেই অনুমেয় ছিল। এর আগে দুবার অস্কার জিতে নিলেও ‘টার’ মুভির ‘লিডিয়া টার’ চরিত্রকে কেট ব্ল্যানচেটের ক্যারিয়ারসেরা বলে মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু অস্কার এক্ষেত্রে নিরাপদ পথটিই বেছে নিয়েছে।
সেরা পার্শ্ব-অভিনেতা
এ বিভাগে যে কি হিউ কুয়ান জিতবেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন এতদিনকার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোর দিকে নজর রাখা প্রায় সবাই। ব্যাপারটা অনেকটা ২০০৯ সালের ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ কিংবা ২০১৯ সালের ব্র্যাড পিটের মতো। ভিয়েতনামি এই অভিনেতাকে ছোটবেলায় শরণার্থী হিসেবে পরিবারের সাথে নৌকায় বসবাস করা লাগত। সেখান থেকে নিজেকে তিনি নিশ্চিত অস্কারজয়ীর কাতারে নিয়ে এসেছেন, ব্যাপারটা আসলেই বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক। ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য টেম্পল অফ ডুম’ চলচ্চিত্রের শর্ট রাউন্ড কিংবা ‘দ্য গুনিজ’ এর ডাটা চরিত্রগুলো বেশ জনপ্রিয় হলেও হলিউডে নিজের যোগ্য চরিত্রের অভাবে অভিনয় থেকে বেশ দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি। শর্ট রাউন্ডকে নিয়ে বানানো একটা মিল থেকে তাকে খুঁজে বের করেন পরিচালকদ্বয়। কি হিউ নিজেও সু্যোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ব্যাটে-বলে মিলে যেতেই ছক্কা হাঁকিয়ে দিলেন তাই। বহুদিন পরে এই অঙ্গনে ফিরে হ্যারিসন ফোর্ড কিংবা ব্রেন্ডন ফ্রেজারের সাথে তার মোলাকাতের দৃশ্যে আবেগঘন হয়েছেন অনেক ভক্তই। এ বিভাগের মনোনীত অন্যেরা হলেন – ব্রেন্ডন গ্লিসন, ব্যারি কিওঘান, জাড হার্শ এবং ব্রায়ান টাইরি হেনরি। এর মাঝে দুই আইরিশ অভিনেতা ব্রেন্ডন গ্লিসন এবং ব্যারি কিওঘান তাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য অনেকেরই পছন্দের তালিকায় ছিলেন।
সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী
এই বিভাগে জেমি লি কার্টিস জিতে কিছুটা তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। তারকা বাবা-মায়ের সন্তান জেমি লি সেই সত্তরের দশক থেকেই দর্শককে মাতিয়ে এসেছেন নানা চলচ্চিত্র দিয়ে। প্রথমে ‘স্ক্রিম কুইন’ হিসেবে খ্যাতি পেলেও ভিন্ন মাত্রার অনেক চরিত্রেই অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ এর ছোট চরিত্রটি তাকে নতুন করে খ্যাতি দিয়েছে, মিশেল ইয়োর সাথে তার সিস্টারহুডও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এই অস্কার সম্ভবত তিনি নিজেও আশা করেননি। এই বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন ক্যারি কন্ডোন, অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট, স্টেফানি স্যু এবং হোং চাও। তাদের মাঝে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্দা ফরেভার’ মুভির জন্য অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেটকে এগিয়ে রেখেছিলেন অনেকেই। তার ‘হ্যাভ আই নট গিভেন এভরিথিং’ মনোলগের মতো শক্তিশালী পারফরম্যান্স মার্ভেল মুভিতে কেউ আশা করেনি। এছাড়া টানাপোড়েনে ভোগা ‘শিওভান’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ক্যারি কন্ডোনও ছিল যোগ্য দাবিদার।
সেরা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র
এই বিভাগে ‘গিয়ের্মো দেল তোরো’স পিনোকিও’ মুভির জয় প্রত্যাশিতই ছিল। এর মাধ্যমে গিয়ের্মো দেল তোরো গড়লেন অনন্য এক ইতিহাস। এর আগে ‘দ্য শেপ অফ ওয়াটার’ দিয়ে সেরা চলচ্চিত্র এবং সেরা পরিচালকের অস্কার জিতেছিলেন তিনি। অস্কারের ইতিহাসে তিনিই প্রথম পরিচালক যিনি এই তিন বিভাগে অস্কার পেয়েছেন। ইতালিয়ান জনপ্রিয় গল্প পিনোকিওর অ্যাডাপ্টেশন এর আগেও অনেক দফা হয়েছে। কিন্তু গিয়ের্মো নিজের ছায়ায় গথিক ভঙ্গীতে দুর্দান্ত এক ডার্ক ফ্যান্টাসিতে রূপ দিয়েছেন একে। এখানে কণ্ঠ দিয়েছেন ইওয়ান ম্যাকগ্রেগর, টিলডা সুইনটন, কেট ব্ল্যানচেট, ক্রিস্টফ ওয়ালতজের মতো বড় বড় তারকারা। কাঠের পুতুল থেকে মানুষ হবার জন্য ছটফট করতে থাকা পিনোকিওর কণ্ঠ দিয়েছেন গ্রেগরি ম্যান। তার চিরন্তন গ্লানিতে ভোগা তার বাবার কণ্ঠে অনবদ্য কাজ করেছেন ডেভিড ব্র্যাডলি। গিয়ের্মোর আগের মুভি ‘নাইটমেয়ার অ্যালি’র সেটের কিছু অংশ ব্যবহার করা হয়েছে এই স্টপ মোশন ছবিটিতে। এই বিভাগে মনোনীত অন্য চলচ্চিত্রগুলো হলো মার্সেল দ্য শেল উইথ শুজ অন, টার্নিং রেড, দ্য সি বিস্ট, এবং পুস ইন দ্য বুটস: দ্য লাস্ট উইশ।
বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্র
যুদ্ধ ভয়াল, নারকীয়। কিন্তু শুধু কতিপয় বিশেষণ কিংবা পরিস্থিতি দিয়ে এর বীভসৎতা তুলে ধরতে পারে কয়জন? ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের অবদান তাই বরাবরই থাকবে। এরিখ মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী এই ক্লাসিকটি নির্মাণের ক্ষেত্রে মূল বাধা ছিল উচ্চাকাঙ্খী প্রোডাকশন। সেই পরীক্ষায় ভালোমতোই উৎরে গিয়ে এই মুভিটি জিতে নিয়েছে সেরা প্রোডাকশন ডিজাইন এবং সেরা চিত্রগ্রহণের অস্কার। আর অশুভ আবহসঙ্গীতের জোরে সেরা মিউজিকাল স্কোরও গেছে এর ঘরেই। তবে সিনেমার মূল শক্তি কিন্তু অভিনয়। ‘কাম অ্যান্ড সি’ এর ফ্লিয়োরা কিংবা অল কোয়ায়েটের পল তো একই পথের যাত্রী। তাদের প্রাণে ভরপুর দুই চোখ থেকে প্রাণ হারিয়ে যাওয়ার যাত্রাটুকুই তো দর্শকের সঙ্গী। বিদেশি ভাষায় সেরা চলচ্চিত্রের অস্কারটি তাই অবধারিতই ছিল। এই বিভাগে মনোনীত অন্য চলচ্চিত্রগুলো হলো আর্জেন্টিনা, ১৯৮৫ (স্প্যানিশ, আর্জেন্টিনা), ক্লোজ (ফ্রেঞ্চ/ডাচ, বেলজিয়াম), ইও (পোলিশ, পোল্যান্ড), এবং দ্য কোয়ায়েট গার্ল (আইরিশ, আয়ারল্যান্ড)।
সেরা চিত্রনাট্য (অরিজিনাল)
অস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো সেরা চিত্রনাট্য। আর এই বিভাগেও জিতে বছরটাকে নিজেদের করে নিয়েছেন ড্যানিয়েলদ্বয়। গত বছরের শুরুর দিকে মার্ভেলের ডক্টর স্ট্রেঞ্জের মাল্টিভার্স নিয়ে ভীষণ মাতামাতি হচ্ছিল। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের এই ধারণা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন কিংবা ফ্যামিলি ড্রামার আদলকে ভেঙেচুরে অনন্য এক কাহিনী সাজিয়েছেন তারা। অ্যাকশন, ফ্যান্টাসিময় কাহিনীর ভিড়ে বিভিন্ন পপ কালচার আর মন্তাজ দিয়ে মাতিয়েছেন দর্শকদের। আর শেষে গিয়ে পুরো কাহিনীকে একসূত্রে গেঁথেছেন দারুণভাবে। আদিকালের দার্শনিক আর হালের কসমোলজিস্টদের তত্ত্বকে মিলেমিশে এমন কিছু বানিয়েছেন, যা অত্যাশ্চর্যভাবে জগাখিচুড়ি হতে গিয়েও হয়নি। এই বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন মার্টিন ম্যাকডোনাহ ((দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন), স্টিভেন স্পিলবার্গ (দ্য ফ্যাবলম্যানস), টনি কুশনার (দ্য ফ্যাবলম্যানস), টড ফিল্ড (টার), এবং রিউবেন আস্টলান্ড (ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস)। দুই বন্ধু তথা দুই আয়ারল্যান্ডের বিচ্ছেদকাহিনীর অনন্য এক উপস্থাপনার কারণে এই বিভাগের যোগ্য দাবিদার ছিলেন ম্যাকডোনাহ।
সেরা চিত্রনাট্য (অ্যাডাপ্টেড)
সেরা চলচ্চিত্রের মনোনয়ন পাওয়া ‘উইম্যান টকিং’ এর চিত্রনাট্যের জন্য অস্কার পেয়েছেন সারাহ পলি। মুভিটি পরিচালনাও করেছেন তিনি। এই কানাডিয়ান অভিনেত্রী কাম পরিচালক এর আগেও ‘আমোর’ দিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন। বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা মিরিয়াম টয়েসের উপন্যাস থেকে সুনিপুণভাবে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন তিনি। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনসেন্ট খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নারীজগতের মনোজগতের ওপর ভিত্তি করে বানানো এই মুভিটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিভাগে মনোনীত অন্যরা হলেন এডওয়ার্ড বার্গার (অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট), রিয়ান জনসন (গ্লাস অনিয়ন), কাজুও ইশিগুরো ((লিভিং), এহরেন ক্রুগার, এরিক ওয়ারেন সিঙ্গার, এবং ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি (টপ গান: ম্যাভেরিক)।
সেরা আবহসঙ্গীত বিভাগে অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এর ভলকার বার্তেলমান একজন যোগ্য বিজয়ী নিঃশন্দেহে। তবে এই বিভাগে ‘টার’ এর মনোনয়ন না পাওয়াটা অবাক করেছে। সেই সাথে ‘লা লা ল্যান্ড’ খ্যাত জাস্টিন হারউইটজকে ‘ব্যাবিলন’ এর মতো এপিক স্কোর বানানোর পরেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। চিত্রগ্রহণ বিভাগে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মনোনয়নই পায়নি ‘দ্য ব্যাটম্যান’। এই বিভাগে বলতে গেলে অনায়াসেই জিতে গেছে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’।
দশক পেরিয়ে কাজ করা ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অফ ওয়াটার’ প্রত্যাশা মিটিয়েছে পুরোদমেই। ভিজুয়াল ইফেক্টস বিভাগে এর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না বললেই চলে। এদিকে অসামান্য সাউন্ড ডিজাইনের জন্য ‘টপ গান: ম্যাভেরিক’ এর জয়ও প্রত্যাশিতই ছিল।
ভারত থেকে বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে যেতে ব্যর্থ হলেও বিদেশে সাড়া ফেলে দেয়া ‘আরআরআর’ জিতে নিয়েছে সেরা সঙ্গীতের পুরস্কার। আর আর রাজমৌলির ক্যাম্পেইন এবং মুভির বিপুল জনপ্রিয়তায় ‘নাটু নাটু’ গানটির অস্কার জয় নিশ্চিত ছিল আগে থেকেই।
কানে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জেতা ‘ট্রায়াঙ্গল অফ স্যাডনেস’ পেয়েছিল সেরা চলচ্চিত্র এবং সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের মনোনয়ন, তবে জেতেনি একটিও। সবচেয়ে বড় আক্ষেপের জন্ম দিয়েছে নয়টি মনোনয়নের পরেও খালি হাতে ফেরা ‘দ্য বানশিজ অফ ইনিশেরিন’। আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ম্যাকডোনাহ ‘ইন ব্রুজেস’ কিংবা ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’র জন্য অনেক আগে থেকে অস্কারের দাবিদার। এছাড়া বছরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘টার’ বেশ আন্ডাররেটেড রয়ে গেছে। জীবনীভিত্তিক আরেক চলচ্চিত্র ‘এলভিস’ ভালো অস্কার বাজ তোলা সত্ত্বেও ফিরেছে খালি হাতে। এদিকে স্টিভেন স্পিলবার্গের নিজের জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘দ্য ফ্যাবলম্যানস’ স্বীয় দুর্বলতাতেই অস্কার মঞ্চে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে।
স্ট্রিমিং সাইটগুলোর মধ্যে নেটফ্লিক্স ছয়টি বিভাগে জিতে পেছনে ফেলেছে সবাইকে। এদিকে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পার্শ্ব-অভিনেতা, সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী এবং সেরা চিত্রনাট্য তথা মূল ৭টি পুরস্কারই গেছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোডাকশক হাউজ এটোয়েন্টিফোরের ঘরে। বিশাল অর্জন বললেও কম বলা হয় একে। তবে মনোনয়নের দিক দিয়েও তাদের জয়জয়কার ছিল। ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’ এর পাশাপাশি রাডারের তলায় থাকা ‘আফটারসান’ও কিন্তু মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছিল। এর আগে ‘মুনলাইট’ এর কারণে প্রথমবার সেরা চলচ্চিত্রের অস্কার পেয়েছিল তারা।
ভারতের ইতিহাসে মুভি নির্মাণের দিক দিয়ে প্রথম অস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন কার্তিকী গঞ্জালেস এবং গুনিত মঙ্গা। তাদের ডকুমেন্টারি শর্ট ফিল্ম ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারারস’ মন জয় করে নিয়েছে সবার।
একনজরে ৯৫ তম অস্কারজয়ীদের তালিকা:
- সেরা চলচ্চিত্র: এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স
- সেরা পরিচালক: ড্যানিয়েল কুয়ান, ড্যানিয়েল শাইনার্ট (এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স)
- সেরা অভিনেতা: ব্রেন্ডন ফ্রেজার (দ্য হোয়েল)
- সেরা অভিনেত্রী: মিশেল ইয়ো (এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স)
- সেরা পার্শ্ব অভিনেতা: কি হিউ কুয়ান (এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স)
- সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী: জেমি লি কার্টিস (এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স)
- সেরা চিত্রনাট্য (মৌলিক): এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স – ড্যানিয়েল কুয়ান, ড্যানিয়েল শাইনার্ট
- সেরা চিত্রনাট্য (অ্যাডাপ্টেড): উইম্যান টকিং – সারাহ পলি
- বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্র: অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (জার্মানি)
- সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র: গিয়ের্মো দেল তোরো’স পিনোকিও
- সেরা আবহসঙ্গীত: অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট – ভলকার বার্তেলমান
- সেরা সংগীত: নাটু নাটু (আরআরআর)
- সেরা শব্দগ্রহণ: টপ গান: ম্যাভেরিক
- সেরা চিত্রগ্রহণ: অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট – জেমস ফ্রেন্ড
- সেরা প্রোডাকশন ডিজাইন: অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
- সেরা সম্পাদনা: এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স
- সেরা ভিজুয়াল ইফেক্ট: অ্যাভাটার – দ্য ওয়ে অব ওয়াটার
- সেরা মেকআপ অ্যান্ড হেয়ারস্টাইলিং: দ্য হোয়েল
- সেরা কস্টিউম ডিজাইন: ব্ল্যাক প্যান্থার: ওয়াকান্দা ফরেভার
- সেরা লাইভ-অ্যাকশন শর্ট ফিল্ম: অ্যান আইরিশ গুডবাই
- সেরা অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম: দ্য বয়, দ্য মোল, দ্য ফক্স, অ্যান্ড দ্য হর্স
- সেরা ডকুমেন্টারি ফিচার: নাভালনি
- সেরা ডকুমেন্টারি – শর্ট সাবজেক্ট: দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারারস