ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহুল আলোচিত আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘিরে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজ্য।
মঙ্গলবার সকালের দিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সচিবালয় অভিমুখে ‘নবান্ন অভিযান’ নামে বিশাল পদযাত্রা শুরু করেছে শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ।
সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই আন্দোলনের ফলে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রসমাজের ডাকে হাজার হাজার মানুষ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিতে নবান্ন অভিমুখে মিছিল শুরু করেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে। তবে বিক্ষোভকারীরা পাল্টা ইট-পাথর নিক্ষেপ করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
মমতা তা করবেন না যা হাসিনা করেছেন
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘পুলিশ এ রাজ্যকে বাংলাদেশে পরিণত করতে দেবে না। ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারও এ রাজ্যাকে বাংলাদেশ করতে দেবে না।’
আরজিকর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি ছাত্রীর মৃত্যুর ন্যায়বিচারের দাবিতে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজ্যটির কোচবিহার জেলার সাগরদিঘী পাড়ে এক বিশাল জমায়েতের ডাক দিয়েছিল তৃণমূল। সেই কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখতে গিয়েই এই মন্তব্য উদয়ন গুহর।
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট কলকাতার ঐতিহ্যবাহী সরকারি হাসপাতালের (আরজিকর) পোস্ট গ্রাজুয়েট দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ উঠে। এরপর থেকেই গত কয়েকদিন ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। আরজিকরের মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাতো বটেই, তার সাথে যোগ দিয়েছেন রাজ্যের অন্য সরকারি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। ফলে আন্দোলনের মাত্রায় গতি পেয়েছে।
আরজিকরের ওই নৃশংস হত্যার ঘটনায় দোষীদের ফাঁসির দাবিতে বুধবার গোটা রাজ্যে ‘রাত দখলে’ নেমেছিল নারীরাও। কিন্তু তারই মাঝে বুধবার মধ্যরাতেই আরজিকর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে তাণ্ডব চালায় একদল মানুষ। নষ্ট করা হয় হাসপাতালের জীবনদায়ী ওষুধ, ভাঙচুর করা হয় একাধিক যন্ত্রপাতি, জানলা, দরজা, টেবিল, চেয়ার, পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল। হামলা চালানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া গণমাধ্যমের কর্মীদের উপরেও।
প্রতিবেশী বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও যেভাবে ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তবে কি বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি হতে চলেছে এপার বাংলাতেও?
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই হামলাকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাজ্যটির উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী শনিবার বলেন, ‘ওই ঘটনার পরে যারা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দিকে আঙুল তুলছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নোংরা ভাষায় মমতা ব্যানার্জিকে গালাগাল করছেন, যারা আঙুল তুলে মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগ চাইছেন- সেই আঙুলগুলিকে চিহ্নিত করে সেই আঙুলগুলোকে ভেঙে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।
নাহলে এরা বাংলাকে নতুন করে একটা বাংলাদেশ তৈরি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ওরা জানে না, হাসিনা যে ভুল করেছেন, মমতা ব্যানার্জির সেই ভুল করবেন না, করেননি। তাই আরজিকর মেডিকেল কলেজে ওইভাবে তাণ্ডব ও ভাঙচুর চালানোর পরেও পুলিশ কিন্তু গুলি চালায়নি। পুলিশ এখানে বাংলাদেশ করতে দেবে না। সরকার এখানে বাংলাদেশ করতে দেবে না। তৃণমূলের কর্মীরা সাধারণ মানুষের সহায়তা নিয়ে এ বাংলাকে বাংলাদেশ করতে দেবে না।’
এই একই ইস্যুতে দুদিন আগে বিরোধীদলকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘সিপিআইএম এবং বিজেপি আপনারা রাজনীতি করছেন। আপনারা ভাবছেন বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আমরা সেটাকে টেনে এনে যদি ক্ষমতা দখল করতে পারি! কিন্তু আমি বলব, আমি ক্ষমতার মায়া করি না। আমি মনে করি যতদিন বাঁচবো, মানুষের সেবা করে যাব, মানুষকে ন্যায়বিচার দিয়ে যাব।’
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি করতে চাইছে : মমতা
কলকাতার সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (আরজিকর) নারী চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ন্যায়বিচার চেয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে তার সাথে বাংলাদেশের ঘটনার সাথে তুলনা টানলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
বিরোধীদলকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সিপিআইএম এবং বিজেপি আপনারা রাজনীতি করছেন। আপনারা ভাবছেন বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আমরা সেটাকে টেনে এনে যদি ক্ষমতা দখল করতে পারি! আমি বলব আমি ক্ষমতার মায়া করি না। আমি মনে করি যতদিন বাঁচবো মানুষের সেবা করে যাব, মানুষকে ন্যায়বিচার দিয়ে যাব। আর যার জন্যই আমি দোষীর ফাঁসির দাবি করেছিলাম। আমাদের পুলিশকে দিয়ে আমরা অনেক কাজ করিয়েছিলাম তা সত্ত্বেও আপনারা হাইকোর্টে গেলেন।’
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। তার আগে বুধবার বেহালায় এ সম্পর্কিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
গত ৯ আগস্ট কলকাতার সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (আরজিকর) নারী চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ন্যায় বিচার চেয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল গোটা পশ্চিমবঙ্গ। প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ডাক্তারদের মধ্যে। পথে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো। হাত মিলিয়েছে সাধারণ মানুষও।
ইতোমধ্যেই ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন আরজিকরের প্রিন্সিপাল ডা. সন্দীপ ঘোষ। কলকাতা পুলিশের হাত থেকে তদন্তভার চলে গিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে। দায়িত্ব পেয়ে তারাও তদন্তে নেমে পড়েছেন।
এরই মধ্যে স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে রাজ্যজুড়ে রাস্তায় নামেন নারীরা। নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে স্বাধীনতার মধ্যরাতে বুধবার কলকাতাসহ রাজ্যটির জেলায় জেলায় পথে নামেন নারীরা। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেয়েদের রাত দখল’।
এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আরজিকরের ঘটনা টেনে এনে যারা চরিত্র হরণ করছে এরা ছাত্র-ছাত্রী নয়। এরা হচ্ছে রাজনৈতিক দল। পরিকল্পিতভাবে করছে। কারণ তারা মমতা ব্যানার্জিকে সরাতে চায়। আরে মমতা ব্যানার্জির শর্তে রেল থেকে দুবার সরে এসেছে। জাস্ট একটা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছি। আমার এক সেকেন্ড লাগে কিন্তু আমি অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথা নত করিনি করবোও না।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। আর তাতেই পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পর থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন হাসিনা। সেই থেকে ভারতেই অবস্থান করছেন তিনি।
আপনার মন্তব্য লিখুন