মিয়ানমারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেড (মূল্যবান পাথর) খনির দখল নিয়ে বিদ্রোহী গ্রুপ কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (কেআইএ) এবং সামরিক জান্তার মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। এই পাথর দিয়েই বানানো হয় মূল্যবান জেড পাথর।
স্থানীয় অধিবাসী এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বছরের শুরু থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়। তবে যুদ্ধ বর্তমানে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর অর্থ সংগ্রহের জন্য জান্তাবাহিনী এবং বিদ্রোহী গ্রুপ কেআইএ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক এই উৎসের ওপর।
কাচিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অং সেইন মিন বলেন, এর মধ্যে বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হপাকান্ত। তিনি বলেন, সশস্ত্র গ্রুপগুলো এই এলাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এটা সামরিক এবং আর্থিক সমর্থনের জন্য কৌশলগত এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ জন্য জেড উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে জোর লড়াই করছে উভয়পক্ষ।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে মোট যে পরিমাণ জেড পাথর উৎপাদন হয় তার প্রায় ৭০ ভাগই মিয়ানমারের এই খনির।
এই পাথর প্রতিবেশী চীনে ভীষণ জনপ্রিয়। গত ২০ জানুয়ারি ৩৩তম মিলিটারি ডিভিশনের কাছ থেকে জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং কেআইএ একসঙ্গে কৌশলগত পাহাড় হওয়ে হকার দখলে নিতে আক্রমণ করে এবং তা তাদের দখলে নেয়। মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে প্রবেশের জন্য হপাকান্ত একটি বড় গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলেছেন, ২ ফেব্রুয়ারি ন্যাম তেইন সামরিক ক্যান্ড নিজেদের দখলে নিয়েছে কেআইএ এবং পিডিএফ। নাম প্রকাশ না করে একজন অধিবাসী বলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়। এক দশক ধরে এখানে অবস্থান করছিল সেনাবাহিনী। বিদ্রোহীদের মারাত্মক হামলায় এসব পাহাড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী।
সূত্র: রেডিও ফ্রি এশিয়া
মিয়ানমারের ৭ এলাকায় জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা
মিয়ানমারের উত্তর শান প্রদেশের দখলকৃত ৭টি এলাকায় একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির বিপ্লবী সংগঠন পালাউং স্টেট লিবারেশন ফ্রন্ট (পিএসএলএফ)। আগামী বছরে তারা এই সরকার গঠন করবে। খবর দ্য ইরাবতি।
পিএসএলএফ হলো দেশটির সশস্ত্র সংগঠন তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) রাজনৈতিক শাখা। দলটি ১৯৯২ সালে থাই সীমান্তে গঠিত হয়েছিল। শান প্রদেশের নামহসান, মান্টং, নামহকাম, কুটকাই, নামতু, মংলোন এবং মংগাও দখল করেছে টিএনএলএ’র যোদ্ধারা।
যেকোনো সশস্ত্র সংস্থার দ্বারা জোরপূর্বক নিয়োগ করা প্রতিরোধ এবং কর আদায়ে হস্তক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পিএসএলএফ।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং আরাকান আর্মির (এএ) মতো ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের জোটভুক্ত টিএনএলএ। জোট গত বছরের ২৭ অক্টোবর উত্তর শান রাজ্য জুড়ে অপারেশন ১০২৭ শুরু করে। তারা প্রায় ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ দখল করেছে।
পিএসএলএফ সভাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল টার আইক বং গত জানুয়ারিতে তায়াং জাতীয় বিপ্লব দিবসের বক্তৃতায় তায়াং প্রবাসীদের মুক্ত এলাকা পুনর্গঠনে নিজ নিজ এলাকায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্ত করা এলাকাগুলোকে পুনরুদ্ধার করার পদক্ষেপ হিসেবে আমরা জনগণকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনো সহায়তা প্রদানের জন্য আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাই।’
একইসঙ্গে মুক্ত এলাকায় ন্যায্য ও নিরপেক্ষ আইন এবং একটি নতুন নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টার আইক বং।
ইতোমধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কুটকাই এবং নামতুতে নিজেদের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করছে পিএসএলএফ। তায়াং কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা, আইনের শাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
কিউকমের এক বাসিন্দা বলেছেন, ‘সামরিক স্বৈরশাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়াই আমাদের স্বপ্ন। আমরা টিএনএলএ’র উপর নির্ভর করি এবং আশা করি তারা মুক্ত এলাকাগুলোর উন্নয়ন করতে পারবে।’
পিএসএলএফ’র বার্ষিক সভা এই মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এতে ১৮৫ জন সদস্য অংশ নিয়েছিলেন। এক বিবৃতিতে পিএসএলএফ জানায়, মিয়ানমারের জনগণকে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ভাঙতে এবং একটি ফেডারেল, গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। যেখানে সব জাতিগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণভাবে সহযোগিতা করতে পারে। তায়াং সম্প্রদায় বিরোধ ও সামরিক শাসনে জর্জরিত।
কে জিতল মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে ?
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে কারা? এটি কি সেনাবাহিনী, যেটি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে, নাকি বিভিন্ন সশস্ত্র প্রতিবাদী গোষ্ঠী, যারা গোরিলা কৌশল অবলম্বন করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে?
প্রশ্নটি শুধু দেশটির ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের নয়, বরং প্রতিবেশি দেশগুলো এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা পর্যবেক্ষকরাও একই প্রশ্ন করছেন।
গত ছয় সপ্তাহে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ এবং সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।
এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম, “মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কি যুদ্ধে হারতে শুরু করেছে?”
সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ডেভিস মনে করেন যে সেনাদের বিরুদ্ধে লড়া প্রতিবাদী শক্তিগুলো জয় পাচ্ছে যদিও সেনাঅভ্যুত্থানের পরপরই তিনি মনে করেছিলেন যে, কোনেও ধরনের প্রতিবাদ কোনেও ফল বয়ে আনবে না।
ডেভিস আরও কয়েকটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
তবে, আপনি কোন পত্রিকা পড়ছেন তার উপরেও বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে। যেমন, দ্য ইকোনোমিস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম, “মিয়ানমারের প্রতিরোধ শক্তি নিজেদের প্রচারণা বিশ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।”
এতে লেখা হয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেজিস্টেন্স মুভমেন্টের জয় আসন্ন বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বরং বলা হচ্ছে যে জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ক্রমশ ভেঙে ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং অস্ত্রের অভাবে তাদের পক্ষে গোরিলা হামলা এবং গুপ্তহত্যার বাইরে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে একবারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না কারা এগিয়ে রয়েছে, বা কারা পিছিয়ে পড়ছে। এমনকি যোদ্ধ এবং অস্ত্র সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলোও বিশ্লেষণভেদে আলাদা আলাদা হচ্ছে৷ যেমন ‘ওয়ার অন দ্য রকস’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে যে মিয়ানমারের ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)’-এর একলাখের মতো যোদ্ধা রয়েছে, যাদের ৪০ শতাংশের কাছে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর কোনও কোনোটি ঘরে তৈরি।
কিন্তু ডেভিসের হিসেবে সেনা সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে একলাখের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে বিশ শতাংশেরও কম সশস্ত্র।
সমস্যা হচ্ছে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ প্রতিবেদনই অনির্ভরযোগ্য তথ্য নির্ভর। আর দেশটির গণমাধ্যমও এক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছে না। তাই, এই গৃহযুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বলা মুশকিল।
আপনার মন্তব্য লিখুন