জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলেন বিএনপি নেতারা। বিএনপির অনলাইন বট বাহিনী লাগাতারভাবে জামায়াত বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় মসজিদে কুরআন শিক্ষার অনুষ্ঠানে হামলা, মসজিদের ভেতরে জামায়াত নেতাকর্মীদের মেরে রক্তাক্ত করা, হিজাব পরা নারীদের হেনস্থা ও হামলার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু হটাত করেই দেখা গেল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মিথ্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অথচ এ বিএনপির লোকেরাই একদিন আগে জামায়াতের সাবেক আমীর শহীদ গোলাম আযমকে ফেসবুকে দুই হাত খুলে গালি দিয়েছে। বিএনপির বহু নেতা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথাও বলেছে। সারা দেশে একটা আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে যে নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং তারা জামায়াতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
রাজনীতি যারা ডিপলি জানে তারা অবশ্য জানেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণাকারীরা দলটির ডিফ্যাক্টো প্রধান তারেক রহমান ঘনিষ্ট। গুঞ্জন আছে যোগাযোগ অ্যাপ ওআটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে জামায়াত বিরোধী টকশো প্রচারণা, ফেসবুক ট্রল ও সভাসমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতির নির্দেশনার সঙ্গে তারেক রহমান সরাসরি সম্পৃক্ত। বিষয়টি তার ঘনিষ্টরাই বিভিন্ন সার্কেলে গৌরবের সঙ্গে প্রচার করছে।
এরমধ্যে তারেক রহমানের ঘনিষ্ট সহকারী বলে পরিচিত একেএম ওয়াহিদুযযামান অ্যাপোলো নামে এক ভদ্রলোক ঢাকার সাংবাদিক মহলে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছেন। তিনি বেসরকারি টিভি চ্যানেল আরটিভির একজন তরুণ সাংবাদিককে শিবির বিরোধী মিথ্যা রিপোর্ট না লেখায় চাকরীচ্যুত করেছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে জামায়াত ঘিরে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু একাত্তর ইস্যুতে মিথ্যা মামলায় দলটির টপব্রাশ সব নেতাকে ফাঁসির বিরুদ্ধে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য।
কিন্তু মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের নেপথ্যের কারণটি স্পষ্ট হয়েছে দলটির ডিফ্যাক্টো মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের সব দরজা বন্ধ করতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকুন। দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের সবাইকে এক থাকতে হবে। মতাদর্শে ভিন্নতা থাকলেও দেশের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যদি আমাদের অনৈক্যের কারণে ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটে, জাতি আমাদের ক্ষমা করবে না।
সালাহ উদ্দিনের বক্তব্যে স্পষ্ট যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণেরও বিরোধী বিএনপি। কারণ নির্বাচনই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের প্রধান দরজা। এটিও বিএনপি বন্ধ করতে চায়।
এখন কথা হলো চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর বিএনপি বারবার বলেছে তারা কোনও নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। এমনকি তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দিতেও রাজি।
এরমধ্যে একটা তথ্য হলো, খোদ তারেক রহমান চেয়েছেন নির্বাচনে বিএনপি সরকারে গেলেও জামায়াতের বদলে আওয়ামী লীগ যেন বিরোধী দল হয়। অথচ সে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের সব দরজাই বন্ধ করতে বলছে!
মুলতঃ মির্জা ফখরুল ও সালাহ উদ্দিন মোটেই তারেক রহমানের অনুমোদন ছাড়া জামায়াতের পক্ষে ও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে বক্তব্য দেননি।
বাংলাদেশকে ঘিরে একটি বড় ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির টনক নড়েছে। তাদের হুঁশ হয়েছে যে জামায়াতের বিরুদ্ধে বলে ভারতের মন যোগানোর ধান্ধাবাজির দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং ভারতের দালালি করার পরিচয় বিএনপির জন্য সমূহ থ্রেট হিসেবে হাজির হয়েছে। কাজেই ভারত বিরোধী সাজতে এখন তড়িঘড়ি করে জামায়াত প্রেমিক আর আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী হতে হচ্ছে।
বড় ঘটনা কী
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেছে যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনটি এমন হোক যেন আমাদের দেশ ভারত ও চীনের ছায়ায় আড়ালে থাকা রাষ্ট্র থেকে বের হতে পারে। দেশটি চায় বাংলাদেশ এ অঞ্চলে ভারত ও চীনের মতই একটি স্বাধীন পক্ষ হয়।
কথা হলো যুক্তরাষ্ট্রের এ বার্তার মানে হলো আগামী নির্বাচনে যেন ভারতের দালাল দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সুযোগ না পায়। সেক্ষেত্রে ভারতের নতুন দালাল হতে চাওয়া বিএনপির বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেতিবাচকই। গুরুত্বপূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে পেরেই বিএনপি এখন ভারত ও আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাচ্ছে। এজন্যই জামায়াত নেতাদের ফাঁসি ও লীগের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এত কথা।
আমার এ দীর্ঘ লেখা পড়ে হয়তো বিএনপির অশিক্ষিত ইতর লোকেরা মকারি করবে। এটি তারা অশিক্ষা ও অজ্ঞানতাবশতঃ করবে। আবার খোদ জামায়াতের লোকেরা বা অন্য বাংলাদেশীরা কতটা বুঝেছেন তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
এ কারণে এ লেখাটি মোবাইলে সংক্ষেপে না লিখে ল্যাপটপে লেখছি যেন, লোকজনের লিটারেসির প্রয়োজন সামনে রেখে একটু বড় করে লেখা যায়।
এক্ষেত্রে আমি প্রথমেই কিছু খুচরা তথ্য সামনে আনতে চাই, পরে বড় তথ্য সামনে আনব।
ভারতপন্থী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার
গুমখুনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিচার শুরু করেছে। এদের পরিচয় হলো বিগত ১৫ বছর ভারতপন্থী হাসিনা রেজিমের হয়ে এরা অ্যাক্টর ছিল। সহজ কথায় এরা ভারতের লোক ছিল। এদেরকে যে বিচার করা হচ্ছে তার সঙ্গে মার্কিন সংযোগ আছে।
এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সেনা কর্মকর্তাদের নামে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করার আগে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থানে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে পক্ষ ধরে কাজ করার কথা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে ভারতীয় দালালদের প্রভাবমুক্ত করতে বিচারের যে প্রক্রিয়া তার সঙ্গে মার্কিন সংযোগ আছে এবং এর মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হলো যা না বুঝলে জেনারেল ওয়াকারও বিচারের মুখোমুখি হবেন।
হাসিনার রায় ১৩ নভেম্বর
শেখ হাসিনার বিচার যেন না হতে পারে এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দিতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা হলো। এর মধ্যে আগস্ট থেকেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হচ্ছিল। এমনকি খোদ বিএনপিকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এমন সরকার হলে জুলাই গণহত্যা ও আগের গুমখুনের বিচার বন্ধ হয়ে যেত। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন ও রুটিন দায়িত্ব পালনের বেশি কিছু করার এখতিয়ার নাই। সেই সরকার হলে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে নিষিদ্ধ করারও সুযোগ ছিল না। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার লীগের কার্যক্রম বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। কাজেই বিচার না হলে লীগের নিষেধাজ্ঞা থাকে না, আর অন্তর্বর্তী সরকারতো নিষিদ্ধ করবেই না।
এক্ষেত্রে একটি তথ্য দেই, সম্প্রতি আওয়ামী লীগ যে ঘনঘন মিছিল করছে তা মোটেই দলটি আয়োজন করেনি। এসব মিছিলের নেপথ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার ও গোয়েন্দা সংস্থা, মিছিলকারীরা হলো ভাড়াটে। এসব মিছিলের টার্গেট হলো অন্তর্বর্তী সরকার পরিবর্তন, শেখ হাসিনার বিচার বন্ধ ও আওয়ামী লীগকে ফেরানো।
কিন্তু আগামী নির্বাচনকে লীগমুক্ত রাখা ও ভারতের দালাল শেখ হাসিনাকে শায়েস্তা করার যে জরুরত আছে তার সামনে সেনাপ্রধান ও ভারতের কোনও উদ্যোগই পাত্তা পায়নি। তারা রীতিমত ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করেছে, আগামী ১৩ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের রায় হবে। রায়ে দুজনেরই কঠোর শাস্তি হবে, কারণ ম্যাসাকারে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
মুলতঃ হাসিনার রায় হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অবসান ঘটবে। এমনকি রিফাইন্ড আওয়ামী লীগও ভাত পাবে না। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের ছায়া থেকে বের করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকেই অনুসরণ করা হবে।
ট্রাম্পের বাংলাদেশ নীতির প্রকাশ বড় ঘটনা
এক বছরেরও বেশি সময় পরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের বাংলাদেশ নীতি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মতই বাংলাদেশের সঙ্গে জোরদার সম্পর্ক করা হলো ট্রাম্পের নীতি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারত ও চীনের পাশে একটি শক্তিশালী স্বাধীন পক্ষ হিসেবে দেখতে চাওয়া হলো ট্রাম্পের নীতি।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূতের নাম ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন। তার নিয়োগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি কাউন্সেলর শ্রেণীর একজন কূটনীতিক। বাংলাদেশে তার পদটি রাষ্ট্রদূতের হলেও পদটির নাম হলো ‘অ্যাম্বাসেডর এক্সট্রাঅর্ডিনারি অ্যান্ড প্লেনিপোটেনশিয়ারি’। মানে হলো তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কূটনীতিক। এরকম কূটনীতিকরা তার দেশের সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব করার পূর্ণ এখতিয়ার রাখেন, বিশেষ করে নিজ দেশের সরকারের অনুমোদন ছাড়াই অন্য দেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা ও চুক্তিতে উপনীত হতে পারেন। এই পূর্ণ ক্ষমতা তাদেরকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীন এজেন্ট, চুক্তি স্বাক্ষরে সক্ষম ও নিজ দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে সমর্থ করে তোলে।
কাজেই নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন তার পদ মর্যাদার কারণে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তিনি নিজেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চুক্তি করবেন, যা করার এখতিয়ার বেশিরভাগ কূটনীতিকেরই থাকে না। তিনি কোনো চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে সরাসরি অথরিটি হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন, এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনে তাকে চুক্তিপত্র পাঠিয়ে অনূমোদন আনতে হবে না। তার পদটি ক্ষমতার প্রতীক বলে বিবেচিত। ফলে তিনি যখন কথা বলবেন তা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং কথা ও কাজের বেলায় পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন।
নতুন রাষ্ট্রদূতের পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হলো তাকে বাংলাদেশে বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজনে দ্রুততমে সময়ে ওয়াশিংটনের নির্দেশনা বা অনুমোদনের জন্য কাল বিলম্ব না করে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
কাজেই ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনের বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে বড় ঘটনা। এই বড় ঘটনা বুঝতে আমাদের খোদ ক্রিস্টেনসেনকে বোঝা দরকার। তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের খুবই ঘনিষ্ট। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সেলর ছিলেন, ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তার মানে তিনি বাংলাদেশকে গভীরভাবে জানেন।
গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে, ‘২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত কমান্ডের (ইউএসএসট্র্যাটকম) কমান্ডারের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তিনি ইউএসএসট্র্যাটকমের বৈশ্বিক কৌশলগত প্রতিরোধ মিশনের পররাষ্ট্রনীতিগত প্রভাব সম্পর্কে কমান্ডারকে পরামর্শ দেন।’ এছাড়াও তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অস্ত্র হস্তান্তর অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর (২০১৬-২০১৯) ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ২ সেপ্টেম্বর ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন দেন। এরপর মনোনয়ন অনুমোদনের জন্য সিনেটে পাঠানো হয়। গত ২৩ অক্টোবর সিনেটে শুনানি হয়। এ শুনানির সময় ক্রিস্টেনসেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ইংগিতবাহী বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছে। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারকে পতন করেছিল। বাংলাদেশে আগামী বছরের শুরুর দিকে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিণাম বয়ে আনা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নতুন সরকার এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথ খুঁজে নিতে এই নির্বাচন হবে। একটি উজ্জ্বল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের এই অভিযাত্রায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ প্রায়শই তার প্রাপ্য মনোযোগ পায় না, কারণ এটি তার আরও বড় প্রতিবেশীদের ছায়ায় ছাপিয়ে যায়।’
‘আমার ফরেন সার্ভিস ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি নিয়ে কাজ করার বিশ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা, এর আগে ঢাকা সফরের কারণে আমি এর গুরুত্ব এবং সেখানে মার্কিন স্বার্থের গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝতে পারি। কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশকে একটি উন্মুক্ত, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার করে তোলে।’
‘যদি নিশ্চিত হয় (রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ) আমি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং এর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উত্তরসূরি উভয়ের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে দূতাবাসের ঢাকা টিমকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছি। প্রায়শই নতুন এশিয়ান টাইগারদের মধ্যে একটি হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে। প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে, বাংলাদেশের জনগণের স্থিতিস্থাপকতা ও এই অধ্যবসায়ের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হয়।’
শুনানিতে সিনেটর পিট রিকেটস বলেন, ‘আমরা যে আরেকটি হুমকির মুখোমুখি হচ্ছি, তা হলো কমিউনিস্ট চীন। বাংলাদেশ ও কমিউনিস্ট চীনের মধ্যে সামরিক পরিসরে সহযোগিতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কমিউনিস্ট চীন একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সাবমেরিন ঘাঁটি সংস্কার করেছে, যাতে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন দুটোই রাখা যায়। আর এই মাসেই খবর এসেছে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ ২০টি চীনা নির্মিত জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। তারা নতুন সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং দীর্ঘপাল্লার রাডারও সংগ্রহ করবে। এর মাধ্যমে তারা চীনা প্রতিরক্ষাশিল্পের সঙ্গে আর্থিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন করছে। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত হলে কীভাবে আপনি বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, যাতে তারা চীনা সমরাস্ত্রের ওপর আরও নির্ভরশীল না হয়, তাদের প্রতিরক্ষা ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হয়?
জবাবে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ে আপনার উদ্বেগের সঙ্গে আমি একমত। আমার মনোনয়ন নিশ্চিত (রাষ্ট্রদূত হিসেবে) হলে বাংলাদেশের সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলব—চীনের কর্মতৎপরতা, তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা, তাদের সামুদ্রিক এলাকায় কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় চীনের ভূমিকার ঝুঁকি স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বের সুযোগ ও সুফলগুলোও তুলে ধরব, বিশেষ করে আমাদের দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতার বিষয়টি।’
পিট রিকেটস বলেন, এই শুনানি এমন সময়ে হচ্ছে, যখন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি গতকাল ‘থিঙ্ক টোয়াইস অ্যাক্ট’ নামের একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে অনুমোদন দিয়েছে। এই বিল অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করা যায়।
পিট রিকেটস বলেন, ‘এই বিল পাস করাটা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমরা অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মোকাবিলা করতে পারি। আশা করি, আমরা এই বিলের মাধ্যমে আপনাকে এমন একটি হাতিয়ার দিতে পারব, যা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করার সময় সহায়ক হবে। কিন্তু আমরা আর কী কী করতে পারি? দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অস্ত্র বিক্রির প্রভাব মোকাবিলায়, আপনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?’
তখন ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘আমাদের মার্কিন সামরিক সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে আমরা মিত্রদেশগুলোর জন্য তৈরি এমন কিছু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তুলে ধরতে পারি, যা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হতে পারে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি প্রিমিয়াম অস্ত্রসামগ্রী কিনতে পারে না। পাশাপাশি আমরা যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে এসব প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাদের আন্তকার্যক্ষমতা বাড়াতে পারি।’
[শুনানির বক্তব্য ইউএনবির বরাতে আজকের পত্রিকা, প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন ও ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে]
কথা হলো নতুন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব, তার নিজের বক্তব্য ও প্রশ্নের জবাব মিলিয়ে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও সামনের দিনগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও কৌশল স্পষ্ট বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারত কিংবা চীন কারো বলয়েই দেখতে চায় না। তারা চায় বাংলাদেশ নিজের মতো চলুক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট অ্যালাই হোক। এই চাওয়ার সঙ্গে বিএনপির ভারতপন্থা মোটেই যায় না। বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে হলে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি কদ্দুর কী করে দেখতে হবে। তবে দলটি রাতারাতি কিভাবে অবস্থান বদলাচ্ছে তা দেখে এটি বোঝা যায় যে বিএনপি নিজেকে বদলানোর বিষয়ে যথেষ্ট তড়িৎ চেষ্টা করছে।
যদিও জামায়াতও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিষয়গুলো অবহিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষ করে দলটির আমীর ডা. শফিক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র করছেন। তার সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের কাদের সাক্ষাৎ হয় এবং দলটি ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে না করবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানাচ্ছেন তা অবশ্য জানা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে বিএনপি কিছু আঁচ করেছে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে বিএনপি জামায়াতকে নির্বাচনে নেওয়ার জন্য খুশি করে কথা বলছে। কারণ সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে, আবার ভোট হলেও সরকার পড়ে যেতে পারে।






