নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি কট্টর হিন্দুত্ববাদ আর তথাকথিত ‘মোদি ম্যাজিক’ কাজে লাগিয়ে টানা এক দশক ভারতে একদলীয় শাসন চর্চা করে আসছে। তবে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ফলে এবারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে মোদির দল।
২০১৯ সালে বিজেপি একাই পেয়েছিল ৩০৩ আসন। এবার মোদির জোট পেয়েছে ২৯২টি আসন। ভারতীয় জনতা পার্টি এককভাবে পেয়েছে ২৪০টি আসন যেখানে সরকার গঠানে প্রয়োজন ২৭২টি আসন।
এই অবস্থায় সরকার গঠনে হাত নরেন্দ্র মোদিকে জোটের শরিকদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। বিজেপির ভরসা চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম ও নীতিশ কুমারের জেডিইউর ওপর। অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশম জিতেছে ১৬ আসনে। অন্যদিকে, বিহারের জেডিইউ এর ঝুলিতে আছে ১২ আসন। টিডিপি ও জেডিইউ’র সম্মিলিত আসন ২৮।
জোট সঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠনে মরিয়া বিজেপি শিবির, চলছে দফায় দফায় ফোনালাপ ও আলোচনা।
বিজেপির এই জোট শরিকদের বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটও। আর এ কাজের দায়িত্ব পড়েছে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে।
জানা গেছে, নীতিশ কুমারকে উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স। বলা হচ্ছে, বিজেপির চেয়ে কংগ্রেসের কাছ থেকে বেশি সুযোগ সুবিধার নিশ্চয়তা পেলে ভোল পাল্টাতে পারেন প্রবীণ দুই রাজনীতিবিদ। অতীতে তাদের সঙ্গী বদলের নজির রয়েছে।
শরিকদের ওপর নির্ভর বা তাদের ভরসায় রাজ্য বা কেন্দ্রে কোথাও সরকার চালানোয় অভ্যস্ত নন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মোদিকে শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এই ব্যবস্থায় তিনি কতটা খাপ খাওয়াতে পারবেন, তা দেখার অপেক্ষা।
রামমন্দিরের প্রচার কাজে লাগলো না , মোদি ঝড় রুখে দিল অখিলেশ-রাহুলের জুটি
দু’বছর আগে বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতের স্লোগান দিয়ে মেরুকরণের তাস খেলে বাজিমাত করেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। এ বারের লোকসভা ভোটে দেশের বৃহত্তম অঙ্গরাজ্যে (জনসংখ্যার নিরিখে) হিন্দুত্বের আবেগ উসকে দিতে বিজেপির মূল অস্ত্র ছিল, নব্বইয়ের দশকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া বাবরি মসজিদের জমিতে গড়ে তোলা রামমন্দির।
কিন্তু সদ্য ঘোষিত ভোটের ফল বলছে, রামমন্দিরের রাজ্যেই ‘মোদি ঝড়’ রুখে দিয়েছেন সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র প্রধান অখিলেশ যাদব এবং তার সহযোগী কংগ্রেস।
ভারতে সংসদীয় রাজনীতির অঙ্ক অনুসারে, দিল্লি দখলের পথ একটাই— ভায়া লখনো। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে এই রাজ্যই। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, চৌধরি চরণ সিংহ, রাজীব গান্ধী, ভিপি সিংহ, চন্দ্রশেখর— সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী লখনো থেকে জিতেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এক দশক আগে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে পৌঁছে দিতেও এই রাজ্যের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এ বারও তার ব্যত্যয় হয়নি।
২০১৪-সালে দেশজুড়ে পদ্মঝড়ে উত্তরপ্রদেশ কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে গিয়েছিল। ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টিতেই জিতেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। তার মধ্যে বিজেপি একাই ৭১টিতে। সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৫টি এবং কংগ্রেস ২টি আসনে জিতেছিল।
২০১৯-এ অবশ্য বিজেপিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল অখিলেশ যাদব এবং মায়াবতীর জোট। উত্তরপ্রদেশের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শত্রুতার প্রাচীর ভেঙে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ১৫টি আসন।
গতবারের ভোটে উত্তরপ্রদেশে একা লড়ে ধরাশায়ী হয়েছিল কংগ্রেস। ৬ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিল একমাত্র রায়বরেলীতে। সনিয়া গান্ধীর আসনে। কিন্তু অমেঠির ‘গান্ধী গড়ে’ বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। এবার কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন অখিলেশ। ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে প্রার্থী দিয়ে ১৭টি ছেড়েছিলেন রাহুল-মল্লিকার্জুন খাড়গের দলকে।
উত্তরপ্রদেশে চিরাচরিত জাতপাতের অঙ্কের পাশাপাশি ভোটের প্রচারে এ বার মোদি জমানায় বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প, জাতগণনা এমনকি, যোগীর বুলডোজ়ার নীতি এবং জেল হেফাজতে বাহুবলী সংখ্যালঘু নেতা আতিক আহমেদ, মুখতার আনসারির মৃত্যুকেও নিশানা করেছিল বিরোধী শিবির। ৪০০ আসন নিয়ে মোদি ক্ষমতায় ফিরলে ওবিসি-দলিতদের সংরক্ষণে হাত পড়বে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন অখিলেশরা।
হিন্দুত্বের আবেগ উসকে দিতে ২২ জানুয়ারি মোদি রামমন্দির উদ্বোধনের ছবি তুলে ধরেছিল বিজেপি। সঙ্গে ছিল বারাণসীর জ্ঞানবাপী এবং মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিতে মন্দির ‘প্রতিষ্ঠা’র প্রতিশ্রুতি। অযোধ্যার মতোই ওই দুই জমি বিতর্কও এখন আদালতে বিচারাধীন।
তবে এসব খুব বেশি কাজে দেয়নি। উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৭টিতে জিতে একক বৃহত্তম দল হয়েছে সমাজবাদী পার্টি এসপি। সহযোগী কংগ্রেস জিতেছে ছ’টিতে। অন্য দিকে, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল জিতেছে ৩৩টি লোকসভা।
জোটের যুগ ফিরেছে ভারতে, সঙ্গে ফিরবে জোট ধর্মও
‘জোট ধর্ম’— ভারতের রাজনীতিতে এই কথাটি বিজেপির প্রয়াত নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে কখনও জোটসঙ্গীদের উপর ভরসা করতে হয়নি। ফলে কাউকে সন্তুষ্ট করারও দরকার পড়েনি। এবার অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী নরেন্দ্র মোদিকে প্রথমবারের মতো সরকার চালাতে জোট ধর্ম পালন করতে হবে।
১০ বছরে টানা দুইবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি। এবার বিরোধী জোট ইন্ডিয়া ব্লকের প্রবল চ্যালেঞ্জে নরেন্দ্র মোদির দল ম্যাজিক ফিগার ২৭২ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এক দশক পর ভারতের কেন্দ্রের রাজনীতিতে জোট যুগ ফিরে এসেছে। বেড়েছে কিংমেকারদের কদর।
নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রের রাজনীতিতে আসার আগে ভারতের ভোটাররা তিন দশক তাদের ম্যান্ডেট ভাগ করেছেন। ফলে জোটের রাজনীতিই ছিল আদর্শ। ৮০, ৯০ দশক এবং চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকের বেশিরভাগ সময় কোনো দলই লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তারপর গুজরাট থেকে দিল্লি এলেন নরেন্দ্র মোদি। তার নেতৃত্বে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অগোছালো জোট সরকারের অবসান ঘটিয়ে বিজেপির কর্তৃত্বের সরকার আসে ভারতে।
এবারও বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু নিজের শক্তিতে ২৭২ এর ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করতে পারেনি তারা। কেন্দ্রে সরকার গড়তে ও চালাতে জোট হিসেবে এনডিএ-র সাংগঠনিক সমর্থনের প্রয়োজন হবে বিজেপির। নরেন্দ্র মোদির জন্য এটিই হবে কেন্দ্রে জোট সরকার চালানোর প্রথম অভিজ্ঞতা। এবার সরকার গড়লে নরেন্দ্র মোদিকে সামলাতে হবে চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতিশ কুমারের মতো ঝানু জোটসঙ্গীদের।
যেভাবে বিজেপির উপহাসের জবাব দিলেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধী
কংগ্রেস নেতা রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বছরের পর বছর ধরে বিজেপির উপহাসের প্রধান লক্ষ্য ছিল। নির্বাচন থেকে শুরু করে যে কোনো জনসভা বা বৈঠক সব জায়গাতেই বিজেপির প্রধান আক্রমণ থাকে কংগ্রেসকে ঘিরে। কিন্তু উপহাসের শিকার সেই কংগ্রেস এবার একাই সেঞ্চুরি করেছে। আর এর জন্য রাহুল গান্ধী ও তার বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন।
সারাদেশে ভারত জোড়ো যাত্রার মাধ্যমে রাহুল গান্ধী তার প্রচারণা শুরু করেছিলেন। তার যাত্রার মাধ্যমে রাহুল দেশের জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন যার প্রতিফলন ঘটেছে ভোটে। এর আগে দেশের জনগণ রাহুলকে শুধু টিভির পর্দাতেই দেখত, কিন্তু তার এই ভারত জোড়ো যাত্রার মাধ্যমে তিনি পুরোপুরিভাবে দেশের সকল প্রান্তের মানুষের মন দখল করে নিয়েছিলেন যা বিজেপির ধারণাকে ভেঙে দিতে অবদান রাখে।
ভারত জোড়ো যাত্রাকালে রাহুল গান্ধীর কুকুরছানাকে আদর করার দৃশ্য, মানুষকে আলিঙ্গন করা এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের জনগণের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, ছাত্র থেকে ট্রাকচালক সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ যা দেশের জনগণ আগে দেখেনি। এটি তার ভোটব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে লোকসভা নির্বাচনে অনেকেই আশা করেছিলেন যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কিন্তু যখন তিনি তা করেননি তখন নানারকম প্রশ্ন উঠেছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় প্রিয়াঙ্কা বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এটি তার একটি সচেতন সিদ্ধান্ত। যদি তিনি এবং রাহুল উভয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তবে তারা একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণার সাথে আবদ্ধ হবেন। কিন্তু তারা দুই ভাইবোনই একসঙ্গে প্রচারণায় আবদ্ধ হতে চাননি। তাই নিজেকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই তিনি নিজেকে মুক্ত রাখেন।
এবারের নির্বাচনে একজন প্রতিবাদী বক্তা হিসেবে প্রিয়াঙ্কার আবির্ভাব ঘটে। কথা দিয়ে তিনি দর্শকদের মোহিত করেন এবং তাদের সাথে মনের ভাব আদান প্রদান করেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভিযোগের পাল্টা উত্তরও দেন।
কংগ্রেস জনগণের স্বর্ণ, মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে- মোদির এমন বক্তব্যের জেরে প্রিয়াঙ্কা বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হয়েছে ৭০ বছর। এর মধ্যে ৫৫ বছরই দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস। এই ৫৫ বছরে কংগ্রেস কি জনগণের স্বর্ণ-মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়েছে। বরঞ্চ যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধী দেশের জন্য তার স্বর্ণ দান করেছিলেন। আমার মা দেশের জন্য তার মঙ্গলসূত্র উৎসর্গ করেছিলেন।
তাদের ভাইবোনের এমন জনসংযোগ দেশের জনগণের কাছে বিজেপি যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল তা ভেঙে দিয়েছে এবং এর প্রেক্ষিতে শাসক দল তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩২৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যা ছিল সর্বকালের সর্বনিম্ন, বাকি ২১৫টি আসন মিত্রদের জন্য ছেড়ে দেয়। মল্লিকার্জুন খাড়গের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের এমন বড় সিদ্ধান্তের পেছনেও বড় ভূমিকা রাখেন রাহুল-প্রিয়াঙ্কা। এই সিদ্ধান্তেও উপকার পেয়েছে কংগ্রেস।
লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এখনও বিজেপির তুলনায় অর্ধেক আসন নিয়ে শেষ করতে পারে, কিন্তু গান্ধী ভাই-বোনরা তাদের দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে বেশ উজ্জ্বল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কংগ্রেসের সংবাদ সম্মেলনে মিস্টার গান্ধী দলের পারফরম্যান্সে বোন প্রিয়াঙ্কার অবদানের কথা তুলেও ধরেন।
গত দুইবারের চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন মোদি
টানা তৃতীয়বারের মতো উত্তর প্রদেশের বারণসি থেকে লোকসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সপ্তাহ ভোট শেষে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, মোদি বারাণসিতে ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এই আসনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অজয় রায় (কংগ্রেস) পেয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ৪৫৭ ভোট। অর্থাৎ মোদি মাত্র ১ লাখ ৫২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন।
মোদি বারণসির এই আসনে মোট ভোটের ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অজয় রায় পেয়েছেন ৪০ দশমিক ৭৪ শতাংশ ভোট।
নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেলেও ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের তুলনায় তার ভোটের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী দলের সালিনী জাদবকে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫০৫ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন। সেবার মোদি ভোট পেয়েছিলেন ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৪টি। অপরদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সালিনী পেয়েছিলেন মাত্র ১ লাখ ৯৫ হাজার ১৫৯ ভোট।
২০১৯ সালে মোদি মোট ভোটের ৬৩ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সেখানে এ বছর এটি ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অপরদিকে ২০১৪ সালে মোদি পেয়েছিলেন ৫ লাখ ৮১ হাজার ২২ ভোট। যা মোট ভোটের প্রায় ৫৬ শতাংশ ছিল। সেবার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অরবিন্দ কেজরিওয়াল পেয়েছিলেন ২ লাখ ৯ হাজার ২৩৮টি ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদি কেজরিওয়ালকে হারিয়েছিলেন প্রায় ৪ লাখ ভোটের ব্যবধানে।
নরেন্দ্র মোদির ‘জনপ্রিয়তার ভীত’ নাড়িয়ে দেওয়া কে এই ধ্রুব রাঠি
সদ্য অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে ‘আবকি বার ৪০০ পার (এবার চারশ পার)’ স্লোগানে নির্বাচনে তুমুল প্রচারণায় নেমেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। লক্ষ্য ছিল ৪০০ আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে অবস্থান নেওয়া। একাধিক বুথফেরত জরিপও বলেছিল, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ৩৭০ থেকে ৪০০ আসনের বেশি পেয়ে তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
তবে চূড়ান্ত ফলে ৪০০ দূরের কথা, ৩০০ আসনও পায়নি বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স–এনডিএ। ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে ২৯২টি।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, মোদি এবার হ্যাটট্রিক করেছেন ঠিকই। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী তার ভোট কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুরুর পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিংয়ে উঠে আসে একটি নাম ‘ধ্রুব রাঠী’। ফেসবুক, এক্সে ছড়িয়ে পড়েছে তার বিবৃতি ‘নেভার আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব অ্য কমন ম্যান।’ বলা হচ্ছে, ‘বিজেপি সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছেন’ এই ওয়ান-ম্যান আর্মি।
ধ্রুব রাঠী কোনো রাজনীতিবিদ কিংবা সাংবাদিক নন; একজন ইউটিউবার। গত কয়েক মাসে নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির কঠোর সমালোচনা করে একের পর এক ভিডিও তৈরি করেছেন তিনি। তার ভিডিও এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে আলজাজিরা, ফ্রান্স ২৪, দ্য ইকনোমিস্ট, টাইম ম্যাগাজিন, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য প্রিন্ট, দ্য ইকনোমিক টাইমসের মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন তিনি।
একটি গবেষণার বরাতে আলজাজিরা জানিয়েছে, ভারতীয়রা মূলধারার নিউজ চ্যানেলের চাইতেও ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া খবরে বিশ্বাস করে বেশি।
এই পটভূমিতে ইউটিউবে শক্তিশালী উপস্থিতি নিয়ে আসেন ধ্রুব রাঠী। ইউটিউবে তার ২১.৫ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, যা বিজেপির ইউটিউব চ্যানেলের প্রায় ৪ গুণ। নরেন্দ্র মোদির ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার রয়েছে ২৩ মিলিয়ন ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাবস্ক্রাইবার রয়েছে ৬ মিলিয়ন। ২৯ বছর বয়সী ধ্রুব রাঠী আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একসময় নরেন্দ্র মোদির ভক্ত ছিলেন তিনি।
২০১৪ সালে রাজনীতিতে মোদির উত্থানে দুর্নীতি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আশা দেখেছিলেন ধ্রুব। তিনি মোদিকে সমর্থক জানিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতায় যাওয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই কয়েকটি ঘটনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন ধ্রুব।
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি (এএপি) জাতীয়ভাবে বিরোধী দলে থাকলেও দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল। তারা একটি দুর্নীতিবিরোধী হেল্পলাইন চালু করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রের মোদি সরকার ওই হেল্পলাইনের নিয়ন্ত্রণের জন্য এএপি রাজ্য সরকারের সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু করে।’
ধ্রুব বলেন, এ টি আমার জন্য খুব মর্মান্তিক মুহূর্ত ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি ভারত থেকে দুর্নীতি অপসারণ করতে আগ্রহী নন। মূলধারার টিভি চ্যানেল মোদি ও বিজেপির পক্ষে এক নাগাড়ে সমর্থন প্রদর্শনের পর তার হতাশা আরও বেড়ে যায়। সেই পটভূমিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে ইউটিউবে তার প্রথম রাজনৈতিক মন্তব্য আপলোড করেছিলেন ধ্রুব। ভিডিওটি সম্পূর্ণরূপে তার ফোনে শ্যুট করা হয়েছিল।
গত আট বছরে তিনি তার প্রধান ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় ৬৫০টি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তার অধিকাংশ ভিডিওর কেন্দ্রে থাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সরকারের সমালোচনা। স্ক্রিনে উপস্থিত হওয়া মাত্রই ব্যাকগ্রাউন্ডে অশুভ সাউন্ডট্র্যাক বাজতে শুরু করে। ভিডিও শুরুর আগে হাসিমুখে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ভারত কি একনায়কত্বে পরিণত হচ্ছে?’
তিনি ব্যাখ্যা করেন, আপাতভাবে ভারতে গণতন্ত্র আছে বলেই মনে হয়; নাগরিকরা বিভিন্ন দলের মধ্যে থেকে নেতা বেছে নিতে পারেন এবং কাকে ভোট দেবেন তা নির্ধারণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল…’তিনি মোদি সরকারের দুর্নীতি, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার এবং মোদি সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন। তিন মাস আগে আপলোড করা ২৯ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে রঙিন অ্যানিমেশন এবং ইনফোগ্রাফ দিয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়া এবং বিরোধীদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণ করার অভিযোগ তোলেন রাঠী। একের পর এক ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী তুলে আনেন কৃষক আন্দোলন, লাদাখ ইস্যু, ইলেকটোরাল বন্ডের স্ক্যাম, ভারতের বেকার সমস্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যু। তথ্য-উপাত্ত, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, আদালতের রায় সব তুলে ধরে তথ্যভিত্তিক ভিডিও তৈরি করেন তিনি।
ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগে সর্বশেষ ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী বলেন, আমি জানি যাদের বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি এটি পাহাড়ের বিরুদ্ধে এক লোকের কথা বলার মতো। কিন্তু আমি মনে করেছি এটা আমার দায়িত্ব। যেখানে গণমাধ্যম ‘গদি মিডিয়া’ (ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে যে মিডিয়া) হয়ে গেছে। তাই কিছু হোক বা না হোক যেটা আমার করা উচিত, যেটা সঠিক কাজ সেটাই আমি করব।
রাঠী জানান, নির্বাচনের আগে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি রাস্তায় প্রজেক্টর বসিয়ে তার ভিডিও জনসম্মুখে দেখিয়েছেন তার ভক্ত ও বিজেপি বিরোধী দলগুলো। এমনকি ভোট দেওয়ার পর গণমাধ্যমে কথা বলার সময় ধ্রুব রাঠীর ভিডিওর রেফারেন্স দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন সাধারণ জনগণ।
ধ্রুব রাঠীর ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো তিনি কথা বলেন একেবারে সাধারণ হিন্দি ভাষায়। তার ভিডিওতে ইংরেজি শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে তিনি ইংরেজি সাবটাইটেল যুক্ত করেন। এতে করে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও তার বিপুল সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
সর্বশেষ ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী জানান, বিজেপির সমালোচনা করে ভিডিও করায় একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ তাকে কুকুর,তেলাপোকা ইত্যাদি গালি দিয়ে কন্টেন্ট বানিয়েছে। ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’, ‘পাকিস্তানের দালাল’, ‘চীন থেকে অর্থপ্রাপ্ত গুপ্তচর’ ইত্যাদি গুজবেও অসংখ্য ভিডিও ছড়ানো হয়েছে। এমনকি এইআই দিয়ে তার কণ্ঠ নকল করে গুজব ছড়ানো হয়েছে।
আল জাজিরাকে ধ্রুব রাঠী বলেন, আমাকে ও আমার স্ত্রী জুলিকে পাকিস্তানের দালাল বলে গুজব ছড়ানো হয়েছে। অনলাইনে আমার স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমাকে নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি ভীত নই। কিন্তু আমি আমার অবস্থান বা আমার ভারতে থাকা পরিবারের অবস্থান কখনোই যাতে প্রকাশ না পায় এ বিষয়ে সতর্ক থাকি।’
তিনি বলেন, দিনশেষে আমি যা করি তা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। আমার চ্যানেল ভারতে নিষিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু এখন কথা বলার সময়, তা না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।