কুমিল্লার লালমাইয়ে মসজিদের ইমামকে পানিতে চুবাতে চাওয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফোরকান এলাহি অনুপমকে রাঙ্গামাটিতে বদলি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শামিম আলম স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
আদেশটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে। এতে লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফোরকান এলাহি অনুপমকে রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলায় বদলির কথা উল্লেখ করা হয়।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌমিতা দাশকে লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর শুক্রবার ভাটরা কাছারিবাড়ি জামে মসজিদে জুমার খুতবা শেষ হবার পর ইমামের পেছনে শার্ট-প্যান্ট পরে বসে ছিলেন লালমাই উপজেলার ইউএনও। পরিচয় না জানায় ইকামত দেওয়ার পূর্বে ইউএনওকে একটু সরে বসতে বলেন ইমাম-মুয়াজ্জিন। তাতে ইউএনও তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। নামাজ শেষে ইমামকে ডেকে নিয়ে তাকে পানিতে চুবানোর কথা বলেন। এরপর ইমাম-মুয়াজ্জিনকে চাকরিচ্যুত করেন ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ।
এ ঘটনার দুইদিন পর জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বিষয়টির সমাধান করেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিন চাকরিতে বহাল থাকেন।
ইউএনওকে নামাজের সময় সরতে বলায় চাকরি গেল ইমামের
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার পেরুল ইউনিয়ন ভূমি অফিস সংলগ্ন ভাটরা কাছারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজের খুতবা চলছিল। শার্ট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক এসে ইমামের বরাবর প্রথম কাতারে (সারি) বসেন। ইকামত দিয়ে নামাজ শুরুর আগে মুয়াজ্জিন সেই ভদ্রলোককে ইমাম বরাবরে জায়গা থেকে একটু সরে জায়গা করে দিতে বললেন।
কিন্তু, ভদ্রলোক সরতে আপত্তি করায় ইমামও তাকে সামান্য সরতে অনুরোধ করেন। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই ওই ইমাম জানতে পারেন, তিনি আর সেই মসজিদের ইমাম নেই। যাকে সরতে বলা হয়েছিল, তিনি ছিলেন কুমিল্লার লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকান এলাহি অনুপম।
শুক্রবার (১৩ অক্টোবরের) এ ঘটনাটি শনিবার (১৪ অক্টোবর) জানাজানি হয়। বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুসল্লিরা। তবে, ঘটনাটি অস্বীকার করেছেন ইউএনও অনুপম। এদিকে, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আবুল বাশার বলেন, খুতবা পড়ার শেষ পর্যায়ে ইমামের বরাবর প্রথম সারিতে শার্ট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক এসে বসেন। ইকামত শেষে নামাজে দাঁড়ানোর সময় মুয়াজ্জিন ওই ভদ্রলোককে একটু সরতে বলেন। এরপর আমি নামাজ পড়াই। নামাজ শেষে আমি মসজিদ থেকে বের হলে ওই ভদ্রলোক আমাকে ও মুয়াজ্জিনকে মসজিদের দক্ষিণে সরকারি পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে উপস্থিত একজন আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনি ওনাকে চিনেন? আমি বললাম, না। তখন তিনি বলেন, উনি আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
আমি তাৎক্ষণিক বলি, স্যার আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি। তখন ইউএনও স্যার উত্তেজিত হয়ে বললেন, কোনো কথা নেই। তোকে এখন পানিতে চুবাবো। তুই কত বড় মাওলানা হয়েছিস, তোর ইন্টারভিউ নেবো। তখন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ ও মেম্বার গোলাপ হোসেনকে মুঠোফোনে কল করে দ্রুত পুকুরপাড়ে আসতে বলি। এরপর তিনি বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ধরতে আমাকে কোরআন—হাদিস ও ইসলামের ঐতিহাসিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পেরেছি। কিছু প্রশ্নের উত্তর পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় দিতে পারিনি।
ইমাম বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বার পুকুরপাড়ে আসার পর ইউএনও স্যার আমাকে প্রশ্ন করেন, আমাকে সরতে বললেন কেন? কোন কিতাবে আছে মুয়াজ্জিন ইমামের বরাবর দাঁড়াতে হবে? তখন স্যারকে বললাম, ইমাম যদি কোনও কারণে নামাজ পড়াতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে ইমামের বরাবর যিনি থাকেন তিনি ইমামের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাছাড়া, আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি। তখন ইউএনও বলেন, আপনি অহংকারী। আমি বললাম, স্যার আমরা অহংকার করে আপনাকে সরতে বলিনি। তখন স্যার ক্ষুব্ধ হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে পানিতে চুবাবেন বলেন।
ইমাম আরও বলেন, একপর্যায়ে তিনি চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বলেন, আমি যখন বলব, তখন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও কমিটির লোকদের আমার অফিসে নিয়ে আসবেন। উত্তরে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, এমনি গেলে যাবে। না গেলে ধরে নিয়ে আসব। প্রায় দুই ঘণ্টা জেরার পর আমি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে পুকুরপাড় থেকে পাকা সড়কের দিকে গেলে মসজিদের মুসল্লি ও স্থানীয় ভাটরা গ্রামের জহিরুল ইসলাম নামের একজন আমাকে বলেন, হুজুর, আপনি ভালো মানুষ। আপনাকে আমরা অনেক সম্মান করি। ইউএনও স্যার এবং চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পাঠাইছে। কালকে থেকে আপনি আর মসজিদে আসবেন না। আসলে অপমান হবেন।
মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ পারভেজ হোসেন বলেন, আমি ইউএনও স্যারকে চিনতে না পেরে সরতে বলেছিলাম। সে কারণে নামাজের পরে ইউএনও স্যার পুকুরপাড়ে নিয়ে আমাকে ও ইমাম সাহেবকে অনেক প্রশ্ন করেন। উত্তেজিত হয়ে ইমাম সাহেবকে কয়েকবার পানিতে চুবাবেন বলেছেন।
মসজিদের মুসল্লি মাসুদ বলেন, সকাল থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকারি পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিলেন। জুমার নামাজে সামনের কাতারে তিনি ইমামের বরাবর বসেছিলেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিন না চিনতে পেরে ওনাকে সরতে বলেছিলেন। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নামাজের পরে পুকুরপাড়ে নিয়ে ইমামকে অনেক বকাবকি করেছেন।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি শুক্রবার অন্য মসজিদে নামাজ পড়েছি। আমাদের মসজিদে উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু, বিকেলে শুনেছি জুমার নামাজের পরে ইমামের সঙ্গে নির্বাহী অফিসারের সমস্যা হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ বলেন, ইউএনও স্যার ইমামকে পানিতে চুবাতে বলেছে কি না, শুনিনি। তবে ইমাম-মুয়াজ্জিন সঠিক কাজ করে নাই। ইউএনও স্যারকে নামাজের সময় সরতে বাধ্য করেছে। এটা তারা করতে পারে না। তাছাড়া, ইমামের এলেম অনেক কম। ইউএনও স্যারের অনেক সহজ প্রশ্নের উত্তর ইমাম দিতে পারেনি। সে কারণে আমি কমিটির লোকজনকে বলেছি ইমামকে বাদ দিতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফোরকান এলাহি অনুপম বলেন, মসজিদের ইমাম উপজেলা থেকে নিয়োগ দেওয়া না। আপনি যে ঘটনার কথা বলেছেন, এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে আমি অবগত নই।