কালো টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। নম্বর প্লেটে লেখা ‘ঢাকা ১৬২/অ’। গাড়ির সামনে জাতীয় সংসদের স্টিকার। হুটার বাজিয়ে গাড়িটি সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাও দু’বছর। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ল্যান্ড ক্রুজারটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় কিনেছিলেন মাত্র এক কোটি ১২ লাখ টাকায়।
তবে দেশে গাড়িটির বাজারমূল্য সাড়ে ১০ থেকে ১১ কোটি টাকা। এখন গাড়িটিতে চড়েন প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা। নিয়ম অনুযায়ী, গাড়িটি সড়কে নামানোর ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন) আবেদন করতে হয়। অথচ দুই বছরেও রেজিস্ট্রেশনের আবেদন করা হয়নি। সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি রেজিস্ট্রেশনহীন গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না বলে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা থাকলেও নিয়ম ভেঙে প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি ঠিকই সড়কে চলছে।
প্রতিমন্ত্রীর গাড়িবিলাস এখানেই শেষ নয়, এর আগে শুল্কমুক্ত আরেকটি গাড়ি আমদানি করে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি পরিবহন পুল থেকে তাঁর গাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার কথা। সেই গাড়িও তিনি নিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানের আরও চারটি গাড়ি নিজে ও স্বজনরা ব্যবহার করছেন। প্রতিমন্ত্রী যে গাড়িটি এখন সার্বক্ষণিক ব্যবহার করেন, সেটিও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে নেওয়া।
গাড়ির বাহার
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খান টিপু সুলতানকে হারিয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) হন কলস প্রতীকের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হন তিনি। মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পর সরকারি পুল থেকে একটি কালো সিডান কার (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-৮৫৭৬) বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বেশি দিন তিনি ওই গাড়িতে চড়েননি। কিছুদিন পর এলজিইডি থেকে একটি টয়োটা প্রাডো গাড়ি নিয়ে (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬১১৪) ব্যবহার শুরু করেন। ওই গাড়িতেই এখন প্রতিমন্ত্রীর স্টিকার লাগানো।
এ ব্যাপারে এলজিইডির দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। এলজিইডি থেকে প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়া টয়োটা প্রাডো গাড়িটির চালক শফিক। তিনিও এলজিইডির কর্মচারী। শফিক জানান, তাঁর বেতন এলজিইডি থেকেই হয়। গাড়িটিও এলজিইডির বলে স্বীকার করেন তিনি।
এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীরই নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) থেকে (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৪১৯৫) সুজুকি ভিতারা গাড়িটি ব্যবহার করছেন প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা। চালকও পিডিবিএফ থেকেই সরবরাহ করা। পিডিবিএফের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৭ সালে পিডিবিএফের উপপরিচালকদের জন্য দুই হাজার সিসির সুজুকি ভিতারা মডেলের ১১টি গাড়ি কেনা হয়েছিল। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়েছিল ৪৫ লাখ টাকা। তখন দুটি গাড়ি প্রধান কার্যালয়ে ব্যবহারের জন্য রেখে দেওয়া হয়। তারই একটি বাসায় ব্যবহারের জন্য প্রতিমন্ত্রী নিয়েছেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) থেকেও একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-১১৮২) নেওয়া হয়েছে, সেটা ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী। বিআরডিবির এক কর্মকর্তা জানান, বিআরডিবির রুরাল লাইভলিহুড প্রজেক্ট থেকে কালো একটি পাজেরো স্পোর্টস কার দেওয়া হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর বাসায় ব্যবহারের জন্য। যশোর এলজিইডির একটি জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-১৬০২) তাঁর গ্রামের বাড়ি মনিরামপুরের স্বজনরা ব্যবহার করছেন।
জানা যায়, প্রথম এমপি হওয়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধায় জাপানি টয়োটা ব্র্যান্ডের ২ হাজার ৯৮২ সিসির ডিজেলচালিত জিপগাড়ি আমদানি করেন। সেটির আমদানি দর ছিল ৬৮ লাখ টাকা। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি ব্যবহারের নীতিমালায় বলা আছে, আট বছর না হওয়া পর্যন্ত ওই গাড়ি তিনি বিক্রি করতে পারবেন না। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর স্বপন ভট্টাচার্য স্পিকারের কাছে ওই গাড়ি বিক্রির আবেদন করেন। অনুমতি পেয়ে তিনি গাড়িটি বিক্রি করে দেন। ওই গাড়ি দীর্ঘদিন রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ব্যবহার করলেও বিক্রির আগে রেজিস্ট্রেশন (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-৩০০০) করে নেন। তবে ওই গাড়ি বিক্রির আগেই ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাপান থেকে ৩ হাজার ৩৪৬ সিসির টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার স্টেশন ওয়াগন জেডএক্স গাড়ি আমদানি করেন, যার চেসিস নম্বর জেটিএমএএবিজে ৩০৪০০২৫১৩। নিজে এলসি খুলে মেসার্স নাভানা লিমিটেডের মাধ্যমে গাড়িটি বন্দর থেকে খালাস করান তিনি। তবে দুই বছরেও সেই গাড়ির নিবন্ধন করেননি। নম্বর প্লেটে ‘ঢাকা ১৬২/অ’ লিখে গাড়িটি চলছে।
দেশে কোনো গাড়ির নম্বর ‘ঢাকা ১৬২/অ’– এমন হয় কিনা জানতে চাইলে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের পরিচালক মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বিআরটিএ এ ধরনের কোনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেয় না। তবে গাড়ি আনার পর আমদানিকারকরা ওয়ার্কশপ থেকে একটি নম্বর দেয়। ওই নম্বরের কোনো বৈধতা নেই।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি রেজিস্ট্রেশনহীন গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না বলে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা আছে। এরপরও কেউ এটা করলে তা অনৈতিক।
গাড়ি শুল্ক সুবিধা
এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালের ২৪ মে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া শুরু হয়। ওই সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। পরবর্তী সময়ে কোনো সরকারই এমপিদের এই শুল্কমুক্ত গাড়ি সুবিধা বাতিল করেনি। একজন যতবারই এমপি হোক না কেন, তিনি দুই মেয়াদে দুটি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ব্যবধান হতে হবে আট বছর। প্রথমে ১ হাজার ৬৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার সিসির গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে সিসির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১ হাজার ৬৫০ সিসি থেকে ৪ হাজার ৫০০ সিসির মোটর বা জিপ ডিজেল, পেট্রোল, হাইব্রিড অথবা বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি করতে পারবেন। শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে যারা গাড়ি ব্যবহার করেন, তাদের ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার সিসি সিলিন্ডার ক্যাপাসিটির একটি গাড়ি আমদানি করতে এখন ২২১ শতাংশ কর ও শুল্ক দিতে হয়। ২ হাজার থেকে ৩ হাজার সিসিতে এর পরিমাণ হয় ৩৬৫ শতাংশ। আর ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার সিসির ক্ষেত্রে ৮২৬ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয়।
এ হিসাবে প্রতিমন্ত্রীর শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা গাড়ির দাম ১ কোটি ১২ লাখ টাকা হলে এর শুল্ক দাঁড়ায় ৯ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার টাকা। সাকল্যে দাম পড়ে ১০ কোটি ৩৭ লাখ ১২ হাজার টাকা। এর বাইরে রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ দিতে হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা।
কী বলছেন প্রতিমন্ত্রী
এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যে গাড়িটি দেওয়া হয়েছিল, সেটা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করি।’ এলজিইডি থেকে নেওয়া গাড়িটি নিয়মিত ব্যবহার করেন বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যশোরে যখন যাই, তখন আমি স্থানীয় এলজিইডির একটি গাড়ি ব্যবহার করি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকেও আমার গাড়ি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, ডিসির কাছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ব্যবহারের জন্য গাড়ি থাকে। শুল্কমুক্ত আমদানি করা গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন এখনও হয়েছে কিনা, বলতে পারছি না। ওটা তো রেজিস্ট্রেশন করতে বলেছিলাম। তবে বিআরডিবি ও পিডিবিএফের কোনো গাড়ি আমি ব্যবহার করি না।’