অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও সদর উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। বিশেষ করে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পুরোটাই বন্যায় ডুবে গেছে। এতে করে বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে আটকা পড়া মানুষ বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন গতকাল রাত থেকে।
ত্রাণ নয়, এখন তারা বাঁচার জন্য নৌকার জন্য হাহাকার করছেন। এরকম পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছে সিলেটের জেলা প্রশাসন। যেকোনো সময় নামতে পারে সেনাবাহিনী।
গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি বিরামহীন বৃষ্টিপাত ও তীব্র বাতাসের কারণে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন উপজেলার মানুষ। বিশেষ করে দুটি উপজেলাই বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সমাজসেবী ও সাংবাদিক মনজুর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এলাকায় চারদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। একে তো রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তারওপর বড় সমস্যা হচ্ছে মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অসহায় পরিস্থিতিতে পড়েছেন। এখন পানিতে আটকা পড়া মানুষের তুলনায় নৌকা অনেক কম। ফলে অনেকে ডুবে যাওয়া ঘরের ভেতর পরিবার নিয়ে বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে বন্যার পানিতে বসতঘর গলা পানিতে ডুবে আছে হাসিব মিয়ার। স্ত্রী সন্তান নিয়ে তিনি কোনমতে টিকে আছেন জানিয়ে বলেন, পানি উঠে গেছে ঘরে। এখন বের হয়ে যে কোথায়ও আশ্রয় নেবো সেরকম পরিস্থিতিও নেই। একা হলে সাঁতার কেটে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করতাম। বাচ্চা-কাচ্চা, পরিবার নিয়ে এখন কেমন এখান থেকে বেরোবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। অনেককে বলেও কোনো নৌকার ব্যবস্থা করতে পারছি না।
বন্যার পানিত আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে সিলেটের জেলা প্রশসকের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত। তিনি আরো বলেন, বন্যাকবলিত এলাকার আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা হয়ে যাবে আশা করি। গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ছাড়াও কানাইঘাট, সদর উপজেলা ও বিশ্বনাথের একাংশ বন্যা কবলিত হয়েছে বলে তিনি জানান।
বন্যায় এরই মধ্যে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক ডুবে গেছে। সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের ওপর দিয়ে পানি তীব্র বেগে বয়ে চলেছে। এসব সড়কে যান চলাচল সীমিত হয়ে গেছে। সুনামমঞ্জ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চললেও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, সুরমা নদীর পানি উপচে সিলেট নগরের উপশহর, তেরোরতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, ছড়ারপার, কালিঘাট, তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, কানিশাইল ও ঘাসিটুলা এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার অনেক রাস্তায় পানি থই থই করছে। বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বাণের পানির সঙ্গে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে। সবমিলিয়ে দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছেন এসব এলাকার মানুষ।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে পানিবন্দি লাখো মানুষ। WB
গত কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যাকবলিত সিলেট। এক মাসের মাথায় ফের বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট জেলা ও মহানগরীর অধিকাংশ জনপদ। এরমধ্যে চরম দূর্ভোগ ও সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দারা। এসব এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি। তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও সেখানে তারা পৌঁছাতে পারছেন না। আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা নিরাপদ স্থানে যেতে এসব এলাকার বাসিন্দারা আর্তনাদ জানাচ্ছেন। এছাড়াও খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার।
রাস্তাঘাট পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ায় লাখো বানভাসী মানুষকে উদ্ধারের জন্য সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না কেউ। এছাড়াও এসব গ্রামীন এলাকায় পৌঁছাতে নৌকা মিলছে না।
সিলেটে এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বন্যায় অসহায় হয়ে পড়েছেন মানুষ। খাবার, বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার পাঁচ উপজেলার বিস্তৃর্ণ জনপদ। লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েছেন পানিবন্দি। অব্যাহত বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে সিলেট নগরীতে সুরমা নদীর পানি প্রবেশ শুরু করে। সুরমার সাথে সংযুক্ত ছড়া ও খাল দিয়ে নদীর পানি প্রবেশ শুরু হয়। কয়েকটি স্থানে নদীর তীর উপচেও পানি ঢুকে নগরীতে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বন্যা আক্রান্ত এলাকার মানুষ। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় স্কুল কলেজে যেতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। আগামী ১৯ জুন থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অভিভাবকরা।
বন্যা আক্রান্ত এলাকার বাসা-বাড়ির পানির রিজার্ভার ট্যাংক বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যা কবলিতদের জন্য নগরীতে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে সিটি করপোরেশন। তবে এসব বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট ও সিলেট পয়েন্টে যথাক্রমে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া আমলসীদ, শেওলা ও শেরপুর পয়েন্টেও পানি বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত রয়েছে। সারি নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া লোভা ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে।
সারি ও পিয়াইন নদীর পানি বেড়ে জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। দ্বিতীয় দফা বন্যায় দিনমজুর ও খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষের ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার সবকিছু তলিয়ে গেছে পানিতে। উপজেলার সকল সড়ক ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে গোয়াইনঘাট। বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে।
কোম্পানীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। ধলাই নদীর পানি ঢুকে পুরো উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। আগেরবার বন্যায় সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে পানি না উঠলেও এবার তলিয়ে গেছে। মহাসড়কের উপরে কোথাও এক ফুট, আবার কোথাও তার চেয়ে বেশি পানি উঠেছে। বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত পাথর ভাঙ্গার মেশিন। বেকার হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা।
জৈন্তাপুর উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সিলেট-তামাবিল সড়ক ছাড়া বাকি সকল সড়ক ও গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। সারি ও পিয়াইন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। সুরমা ও লোভা নদীর পানি বাড়ায় কানাইঘাট উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন