সম্প্রতি ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। এই অধ্যাদেশ নিয়ে সরকারি কর্মজীবীরা বলছেন, তাদের অধিকার হরণ ও কথা বলার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। আর সরকার বলছে, আইনটিতে কারও অধিকার-ই হরণ করা হয়নি, বরং শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই ক্ষুব্ধ সচিবালয়ের কর্মচারীরা। এমনকি সেখানে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে তারা সচিবালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই রোববার (২৫ মে) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আর এতে যেন আন্দোলন আরও ফুঁসে ওঠে। সোমবার (২৬ মে) কাজ বাদ দিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। তারা বলছেন, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আর সরকারও তাদের কঠোর অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে।
অধ্যাদেশে যা আছে
সদ্য জারি করা সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- সরকারের কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হোন, যা অনানুগত্যের শামিল, বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হোন, অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচারণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।
এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্ত করার মতো দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে অধ্যাদেশে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সাতদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্ত কর্মচারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন এবং রাষ্ট্রপতি যা উপযুক্ত মনে করবেন সেভাবে আদেশ দিতে পারবেন।
আন্দোলনরত কর্মচারীরা যা বলছেন
গেল বৃহস্পতিবার (২২ মে) অধ্যাদেশটির খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। ওইদিন থেকেই প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীরা। সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের ব্যানারে ওইদিন থেকেই বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেন। এর পর শনি ও রোববারও এই কর্মসূচি চালু রাখেন। সোমবার (২৬ মে) কর্মচারীদের আরও কয়েকটি সংগঠন একত্রিত হয়ে বিকেল পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করেন।
এ প্রসঙ্গে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অধ্যাদেশটিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। অধ্যাদেশে স্পষ্ট উল্লেখ, কারণ দর্শাণোর নোটিশেও চাকরিচ্যুত করা যাবে। আপনারা জানেন, একটা সরকারি চাকরি পেতে কতটা বেগ পেতে হয়। সেখানে যদি লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দেওয়া হয় তাহলে তো সরকারি চাকরি কেউ-ই করতে পারবেন না। এটিকে আমরা বলছি কালো আইন। এই আইনের সঙ্গে কারা জড়িত তাদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি। অধ্যাদেশটি যদি বাতিল করা না হয় তাহলে আমরা আন্দোলন থেকে পিছু হটব না।’ এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব তাদের সঙ্গে বসার কথা বলেও বসেননি। সেজন্য জনপ্রশাসন সচিবের অপসারণ চান অনেক কর্মী।
সরকারের বক্তব্য
সরকারি চাকরি (সংশোধন) ২০২৫ অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা বিক্ষোভ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ-ই মুখ খুলছেন না। এ নিয়ে রোববার (২৫ মে) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যেটা যে সময়ে দরকার পড়ে, সেই সময়ে সেটা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন ম্যানুপুলেট করার উদ্দেশ্যে আইনটির সংশোধন করেছিল। নতুন সংশোধনীতে ওটা শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে আইনটি যেমন ছিল এখন সেটাই করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারপরও যদি কারও এ নিয়ে আপত্তি থাকে, তারা আলোচনা করতে পারেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আলাপ করা যেতে পারে।’ আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আলোচনা করে সমস্যাটা সমাধান করে নেবেন।’ আর এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। আইনের বিষয় আইন প্রণেতারা বলতে পারবেন।’
নতুন কর্মসূচি
বিক্ষোভরত সরকারি কর্মচারীরা মঙ্গলবারও (২৭ মে) তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য সচিবালয়ের বাইরে থাকা সারাদেশের সরকারি দফতরের কর্মচারীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, এখন থেকে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সবগুলো সংগঠন মিলে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় ঐক্য ফোরাম’ নামে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী এ ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি একেবারেই করা যাবে না। সেক্ষেত্রে এটি কার্যকর হবে কি না বিষয়টি জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে তারা বলেন, ‘নতুন অধ্যাদেশে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, একজন সরকারি কর্মচারীর আচরণ কেমন হবে। তারা (কর্মচারীরা) যেটা করছেন সেটা অধ্যাদেশ পরিপন্থী।’ বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান তারা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ১৫ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। আইন অনুযায়ী সবাই কর্মচারী হিসেবে অভিহিত।